• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোসলখানা নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম

ফাইল ছবি

অপরাধ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোসলখানা নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম

  • মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার
  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০২০

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ২০০ গোসলখানা নির্মাণে প্রায় ৫ কোটি টাকার কাজে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণকাজ করা গোসলখানায় যেসব সুবিধা থাকার কথা সেগুলো না থাকা এবং ঠিকাদারের খরচ বাচাতে একই ক্যাম্পে সব গোসলখানা নির্মাণ করে যেনতেনভাবে বিল উত্তোলনের সব প্রক্রিয়া শেষ করেছে ঠিকাদারের সঙ্গে মিলিত সিন্ডিকেট। আর কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এই কাজের তদারকি করার দায়িত্বে থাকলেও ঠিকাদার একই দপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার শ্যালক হওয়ায় সবকিছু এখানে জায়েজ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট কমিশনের ভাগ বসিয়ে আগেই সবকিছু ঠিক করে রেখেছিল কীভাবে ভাগবাঁটোয়ারা হবে।  

সরেজমিন খোঁজখবর নিয়ে এই বিশাল অনিয়ম, দুর্নীতির ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২০০ গোসলখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে যার তত্ত্বাবধানে থাকবে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রতিটি গোসলখানায় ৩টি করে গোসলখানার ব্যবস্থা রাখা, উন্নতমানের বাথরুম ফিটিং এবং প্রত্যেকটি কাজে উন্নত মানের ইট, বালুসহ সবকিছু ভালো ব্যবহার করার কথা। আর এই প্রতিটি গোসলখানার জন্য ২ লাখ টাকার বেশি 

বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এবং উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেখানে গোসলখানার সুবিধা নেই বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তার স্থাপন করার কথা। কিন্তু ঠিকাদারি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স বির্ল্ডাস’ এখানে খুবই নিম্নমানের কাজ করে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করে প্রায় ৫ কোটি টাকার সরকারি টাকা লুটপাট করছেন বলে জানান স্থানীয়রা। 

উখিয়ার স্থানীয় সংবাদকর্মী মাহমুদুল হক বাবুল জানান, বিভিন্ন সূত্রে গোসলখানা নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পরে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গোসলখানা নির্মাণের নামে সরকারি টাকার লুটপাট করা হচ্ছে; প্রথম ২০০টি গোসলখানা বিভিন্ন দুর্গম ক্যাম্পে করার কথা থাকলেও প্রায় ১০০টির বেশি করা হয়েছে শুধু উখিয়ার ১৯ নাম্বার ক্যাম্পে। আর গোসলখানাগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানে ইট, কংকর এবং নির্মাণসামগ্রী এবং অন্যান্য বাথরুম ফিটিং ও খুবই নিম্নমানের। এ ছাড়া দেয়ালগুলোর বেইস এবং ঢালাই দেওয়া হয়েছে খুবই অল্প। ফলে যেকোনো মুহূর্তে তা ধসে পড়তে পারে। এ ছাড়া কিছুদিন পরেই সব ফিটিং নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উখিয়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এই কাজের তদারকি করার কথা থাকলেও তিনি আগেই নিজের কমিশন ঠিক করে রেখেছে এবং বেশিরভাগ কমিশনের টাকা আগেই নিয়ে ফেলেছে তাই তিনি নিজেই ঠিকাদারের লাভের জন্য কাছাকাছি স্থান ঠিক করে দিয়ে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন; কারণ ঠিকাদার হচ্ছে তারই ঊর্ধ্বতন প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ফখরুদ্দীনের আপন শ্যালক। 

এদিকে সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের দাবি কাগজে-কলমে ২০০টি হলেও বাস্তবে খুব বেশি হলে ১৫০টির মতো করা হবে বাকিগুলো ভুয়া দেখিয়ে বিল করা হবে। উখিয়া উপজেলা সুজন সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ২০১৭ সালের পরে রোহিঙ্গা আসার ফলে উখিয়ার স্থানীয় মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হলেও লাভবান হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামের অসংখ্য ঠিকাদার। এখানে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ হলেও বেশিরভাগ কাজ এখন অকেজো হয়ে গেছে। আর খবর নিয়ে জেনেছি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় যেসব কাজ হচ্ছে সব কাজে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। বিশেষ করে উখিয়া উপজেলায় থাকা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এসব কাজের বিপরীতে কমিশন বাণিজ্য করেছে এরকম বহু প্রমাণ আমাদের হাতে আছে কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওপর মহল থেকে শুরু করে সবাই একইসূত্রে গাঁথা। যে গোসলখানাগুলো হচ্ছে সেখানে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। 

উখিয়া উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহামদ বলেন, আমার জানামতে, এর আগেও গোসলখানা নির্মাণ হয়েছে সেখানেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে আমরা জানি। এর আগে টিউবওয়েল, বাথরুম পানির লাইনসহ অনেক কাজ করেছে যেখানে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে। তাই এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। 

১৯ নাম্বার ক্যাম্পের এ ব্লকের কর্মরত এক বিদেশি এনজিওর কর্মকর্তা মিনহাজ বলেন, এখানে গোসলখানা নির্মাণ করা হচ্ছে দেখেছি তবে সেখানে কীভাবে কাজ করছে সেগুলো দেখা আমাদের কাজ নয়। তবে কাজের মান খুবই দুর্বল হচ্ছে এটা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। এখানে সব এভাবেই হয়, যেনতেনভাবে কাজ করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই হচ্ছে সবার কাজ। যেমন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে এর আগে টিউবওয়েল এবং বাথরুম বসানো হয়েছিল এর মধ্যে ৭০% এখন অকেজো কিন্তু তার বিপরীতে সরকারের শতকোটি টাকার বিল চলে গেছে। আর এখানে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিদর্শনে এলে কোনোভাবেই ২০০ গোসলখানা একসঙ্গে দেখার কোনো সুযোগ নেই তাই কয়েকটি দেখেই চলে যায় ফলে কাগজে ২০০ বলা হলেও বেশিরভাগ বাস্তবে থাকে না। 

এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আল আমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং কাজ সম্পর্কে কোনো কিছুই জানে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। 

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের সহকারী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, বতর্মানে চলা ২০০সহ ৩টি প্যাকেজে ৫০০ গোসলখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি গোসলখানা নির্মাণের জন্য ২ লাখ টাকার বেশি বাজেট ধরা আছে আর কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে আমি জানি না সে ধরনের কেউ জানায়নি। 

নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পে সাইট সিলেকশন করা আমাদের দায়িত্ব নয়, সেটা ঠিক করে ক্যাম্প ইনচার্জসহ এনজিওর প্রতিনিধিরা। আমরা শুধু কাজ করি, আর কে কার আত্মীয় সেটা আমার দেখার বিষয় না। আর কাজে অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে কেউ আমাকে অভিযোগ করেনি তার পরও যখন শুনলাম আমি আগামী সপ্তাহে নিজে গিয়ে দেখব। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads