• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

অপরাধ

ওসিসিতে ধর্ষিতার বিড়ম্বনা

ধর্ষণের শিকার ৫ জনকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২০

সম্প্রতি দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) এ-সংক্রান্ত রোগীও বেড়েছে। এর মাঝেই সংশ্লিষ্টরা বলেন ওসিসিতে ধর্ষিতার বিড়ম্বনার কথা। তাদের মতে, ধর্ষণের শিকার হয়ে হাসপাতালে আসা একটি মেয়ে নিঃসন্দেহে ট্রমাটাইজড থাকেন। সে অবস্থায় দফায় দফায় যখন ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়, তখন মানসিক শক্তি এমনিতেও শেষ হয়ে যায়। এ এক অসহনীয় বিড়ম্বনা ভুক্তভোগীর জন্য। এই নিয়ম পাল্টানো উচিত বলে মত তাদের।  

এদিকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদন, পুলিশের নথি ও গণমাধ্যমসূত্রে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার সত্যতা মেলে। এর মাঝেই বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের প্রয়োগে ঢিলেমি এবং সামাজিক অবক্ষয় এর জন্য দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অপরাধী ছাড় পেয়ে যায় বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১৪১৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সারা দেশ থেকে গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। আর প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিতাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা। এই হিসাব হচ্ছে যারা ওসিসিতে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের। এ ছাড়া দেশের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে অন্যান্য হাসপাতাল এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে যারা চিকিৎসা নেন তাদের হিসাব নেই ওসিসির কাছে। ওসিসির মতে, সাধারণত এর শিকার ১১-১৬ বছর বয়সী মেয়েরা।

গতকাল শনিবার দুপুরে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, ধর্ষণের শিকার হয়ে পাঁচজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা  ৭৬৩টি। এর মধ্যে রাস্তা থেকে অপহরণ করে গাড়ির মধ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলা রয়েছে অন্তত অর্ধেক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলা আইনজীবী সমিতির জনৈক নারী সদস্য তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, ধর্ষণের শিকার হয়ে হাসপাতালে আসা একটি মেয়ে নিঃসন্দেহে ট্রমাটাইজড থাকেন। সে অবস্থায় দফায় দফায় যখন ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়, তখন মানসিক শক্তি এমনিতেও শেষ হয়ে যায়। এ নিয়ম পাল্টানো উচিত।

ওসিসিতে কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) নাসরিন সুলতানার মতে, দিন দিন ভিকটিমের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি ওসিসিতে ভিজিটর সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও কেউ মানছেন না। রাজনৈতিক প্রভাব, কর্মকর্তার প্রভাবসহ বিভিন্ন কৌশলে ধমক দিয়ে ওসিসিতে ঢুকে পড়ে ভিজিটর। এতে করে চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা হয় তেমনি চিকিৎসাধীন নারী-শিশুদের প্রাইভেসি বা আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছু থাকে না।  মনোচিকিৎসকও বারবার নিষেধ করেছেন, ভিকটিমকে বেশি প্রশ্ন যেন না করা হয়। তিনিও তাকে বিশ্রামে রাখতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু এর কোনোটাই রক্ষা করে না ভিজিটররা।

ওসিসির প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন মনে করেন, এসব ভিকটিমের জন্য আলাদা করে কোনো সুযোগ-সুবিধার দরকার নেই। ওসিসিতে যে ব্যবস্থাপনায় ভিকটিমদের সেবা দেওয়া হচ্ছে, তা যথেষ্ট ভালো।

প্রকল্প পরিচালক জানান,  নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে চলে ওসিসি। দেশের বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের একটি প্রধান কর্মসূচি ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য এসব সেন্টার থেকে স্বাস্থ্যসেবা, পুলিশি সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা, সামাজিক সেবা, আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং ও আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শক্ত আইন আছে। কিন্তু শাস্তি দিয়ে খুব বেশি অপরাধ কমানো যায় না। আর এটা ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি বলেন, আমাদের সমাজের ভেতরে অসংখ্য উপাদান আছে যা ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দেয়। আমাদের সমাজে এখানো নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হয়। তাকে সেভাবে উপস্থাপনও করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে।

তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা না করলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আদালতে তাকে অনেক বিব্রতকর প্রশ্ন করা হয়। ফলে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

মানবাধিকার কর্মকর্তা ও আইনজীবী সালমা আলী বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশেই নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আইন প্রয়োগও ঠিকমতো হচ্ছে না। সামাজিকভাবেও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। আর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার হয় না অনেক মামলার। কারণ নানা উপায়ে ভিকটিমকে বিরত রাখা হয়। সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে দেওয়া হয় না। আর এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট নামে নতুন একটি আইন করার কথা বললেও তা এখনো হয়নি বলে জানান এ নারী আইনজীবী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে দেরি করি না। ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়ায় যা করতে হয় তা দ্রুততার সঙ্গেই করে থাকি আমরা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকেই দায়ী করেন। তবে রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার আরো অনেক উপাদান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার একটি অংশ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো মামলা হয় না। আর যেগুলোর মামলা হয় বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেখানে শতকরা মাত্র তিন ভাগ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ। আর নারীদের বাইরে বের হওয়া কিংবা কাজে যাওয়ার বিষয়গুলোকে সমাজে এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।

ধর্ষণের শিকার ৫ জন ঢামেকে ভর্তি : ধর্ষণের শিকার হয়ে পাঁচজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন এ তথ‌্য জানান। তিনি জানান, ধর্ষণের শিকার হয়ে পাঁচজন হাসপাতালে এসেছেন। তাদের হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। পাঁচজনই এখন সুস্থ আছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, এই পাঁচজনের মধ্যে পরীক্ষায় দুজনের ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। বাকি তিনজনের মেডিকেল রিপোর্ট এখনো আসেনি। তিনি এসব ঘটনাকে সামাজিক অবক্ষয় বলে উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads