• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
ক্ষুব্ধ সমাজ বিব্রত দেশ

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

বিচারহীনতার কারণেই বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা

ক্ষুব্ধ সমাজ বিব্রত দেশ

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ১৩ জানুয়ারি ২০২০

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষকের লালসার হাত থেকে বাদ পড়ছে না শিশুরাও। এছাড়া ধর্ষণে বাধা পেয়ে বা শাস্তি পাওয়ার ভয়ে ঘটছে খুনের ঘটনাও। ধর্ষণের মতো এমন জঘন্য ঘটনার ক্রমশ বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ সমাজ, বিব্রত দেশ।

মানবাধিকার কর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে দাবি করেছেন। তারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে ধর্ষণের মামলাগুলো ঝুলে আছে। যেসব মামলায় রায় হয়েছে, সেগুলোও পুলিশি দুর্বল তদন্তের ফলে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ধর্ষকের মনে শাস্তি পাওয়ার ভয়টা থাকছে না।

মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ইতঃপূর্বে যে ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোরই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি এবং মামলাগুলো ঝুলে আছে। এসব কারণে ধর্ষকদের মধ্যে যে নারী-শিশুদের নিয়ে যে মানবিক ভাবনা থাকবে, তা নেই।

তিনি বলেন, আমরা জানি, মিথ্যা মামলা যে হয় না, তা নয়। হত্যা, চুরি-ডাকাতির অভিযোগেও মিথ্যা মামলা হয়। সেটাকে নিয়ে যতটা না নাড়াচাড়া করা হয়, তার চেয়ে বেশি নারী-শিশু মামলা নিয়ে নাড়াচাড়া করা হয়। থানা পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থা থাকার কথা সেটা থাকে না। তাই সঠিক তদন্ত বা বিচার হয় না। সঠিক তদন্ত বা আসামির সাজা যদি না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। কারণ দুষ্কৃতকারী যদি বুঝে যায়, এ ধরনের অপরাধে আজ পর্যন্ত কারো বিচার হয়নি, ভিকটিম ভয়ে ঘরের কোনায় পড়ে আছে।

তিনি আরো বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলার সেফটি সিকিউরিটি, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, যে কোনো সময় যে কেউ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করা কোনো ব্যাপারই না, যদি সঠিক সময়ে সঠিক বিচার করা হয়, অপরাধী সাজা পায়, তাহলে এসব ঘটনা কমে যাবে। এছাড়া স্কুল-কলেজে নৈতিকতা মূল্যবোধ নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। গ্রামগঞ্জে, মাঠে-ঘাটে ধর্ষণের শাস্তি নিয়ে বড় বড় স্ক্রিনে সচেতনতা তৈরি করতে প্রচারণা চালাতে হবে। তাহলে হয়তো ধর্ষণ বন্ধ হবে না। তবে অনেক কমে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, ২০১৮ সালের থেকে ১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দ্বিগুণ। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ, এর বিচার আমরা দ্রুত সময়ে সমাধান করতে পারি না। সামাজিক অপরাধগুলোর বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে না পারলে ওই সমস্ত অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সেই ধরনের অপরাধ করতে আগ্রহ বা উৎসাহবোধ করে।

তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে অপরাধের সংখ্যাটি কমতে থাকে।

তৌহিদুল হক আরো বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা এখনো চাকরি ক্ষেত্রে, সমাজে বা প্রশাসনে বা বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করলেও বা দায়িত্ব পালন করলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ অথবা নারীকেন্দ্রিক অপরাধগুলো প্রতিরোধ করার জন্য নারীরা একত্রিত হতে পারেননি। যখন একত্রিত হতে পারছে না, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষদের আধিপত্য, মনোবল বা নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করে রাখার বা নিচু করে রাখার, পুরুষদের অর্ডার অনুযায়ী নারীদের পরিচালনা করার যে প্রক্রিয়া, সেই ব্যাপারগুলোর একটি প্রক্রিয়া তো আছে। যতক্ষণ না নারীরা একত্রিত হয়ে তাদের অবস্থান, শক্তি কিংবা তাদের সমবেদনা জানান দিতে না পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই পরিবর্তন হবে না।

তিনি বলেন, নারী নির্যাতনকেন্দ্রিক যেসব আইনি পদক্ষেপ বা অন্যান্য যে কর্মসূচি রয়েছে, এই কর্মসূচি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে নারীকে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। যেমন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতো তারা আহত হলে বা নির্যাতিত হলে তাদের সামান্য কিছু সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা— এই যে নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিচার করার বা মূল্যায়ন না করার যে প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়ার সুযোগটি যারা অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি রয়েছে, পুরুষ সদস্য যারা রয়েছে তারা কিন্তু সেই সুযোগটি নিচ্ছে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যদি সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক পরিবর্তন না দেখি, সমানভাবে যদি রাষ্ট্র গুরুত্ব না দেয়, তখন আসলে শুধু নারী নির্যাতন নয়, অপরাধের অন্যান্য ধরন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তার আলামত ও লক্ষ্মণগুলো আমরা এখন বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় লক্ষ করছি।

একজন নারীকে যখন সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে  দেখবে, মূল্যায়ন করবে, সম্মানিত করবে তখন এই জায়গাগুলোর পরিবর্তন হবে।

গত শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, গত ১ থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে ৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হয়েছেন। এরা হলেন- গত বৃহস্পতিবার কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসূলপুরের এক কিশোরী, ভাটারার আরেক কিশোরী, ১ জানুয়ারি সবুজবাগে এক কিশোরী, ১ জানুয়ারি ও ৯ জানুয়ারি রামপুরায় ২ তরুণী ও ৫ জানুয়ারি কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী।

পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, শিশুসহ ধর্ষণের শিকার এরা হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি আছে। এদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে দুজনের ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তবে এরা একাধিক ব্যক্তি দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করতে দেওয়া হবে। তবে তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো আছে। এটা সামাজিক অবক্ষয়। শিশু, প্রতিবন্ধীরা এর শিকার হচ্ছে বেশি। নির্দয় হয়ে যাচ্ছে সবাই। এটা রোধ করতে নানামুখী প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার।

অন্যদিকে গত শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিশিষ্ট আইনজীবী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন অভিযোগ করেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করেছে। নারী ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করবে- এটা কল্পনা করা যায় না। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে পত্রিকার প্রতিটি পাতায় আমরা যে তথ্য পাচ্ছি, এতে বোঝা যায় শুধু ঢাকা শহর না, প্রত্যেকটি জেলা শহরে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ দেশে ধর্ষণ যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে। এসব ঘটছে দেশের আইনশৃঙ্খলা অবস্থার ঘাটতি থাকার কারণে। দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, সেই ঘাটতি দেশের মানুষের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সংবিধানে যে মূল কথাগুলো স্বীকৃত আছে, সেগুলোর মধ্যে বলা হয়েছে আইনের শাসন থাকবে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা থাকবে। এসব বিষয়ে কারো কোনো মতপার্থক্য থাকার কথা না। আমরা যে যেই দলই করি না কেন, যদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোনো মতামত যাচাই করা হয়, তাহলে সবাই বলবে যে, সবকিছুর আগে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads