• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
কক্সবাজার ৩ সার্ভেয়ারের কাছ থেকে কোটি টাকা উদ্ধার

৩ সার্ভেয়ারের বাসা থেকে টাকা উদ্ধার বিষয়ে ব্রিফ করছেন র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক আজিম উদ্দিন

ছবি : বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

কক্সবাজার ৩ সার্ভেয়ারের কাছ থেকে কোটি টাকা উদ্ধার

মাসোহারা গ্রহনকারীদের তালিকা

  • কক্সবাজার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহন শাখায় কর্মরত ৩ সার্ভেয়ারের বাসা থেকে ‘ঘুষের’ বিপুল টাকা উদ্ধার ও সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খানকে আটকের পর ‘থলের বেড়াল’ বেরিয়ে আসছে। ভূমি অধিগ্রহন শাখাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সন্ধান পেয়েছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ চক্রে রয়েছেন জেলা প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক দলের নেতা, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্থানীয় এক শ্রেণীর দালাল। সংশ্লিষ্ঠ একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

র্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ জানিয়েছেন, ৩ সার্ভেয়ারের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া বিপুল সরকারি নথি, হাতে লেখা হিসাব বিবরণীর নোটবুক ও ডায়েরী, মাসোহারা গ্রহনকারীদের তালিকা দেখে এবং আটক সার্ভেয়ার ওয়াসিমকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ভূমি অধিগ্রহন শাখা কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ চক্রের অনেকের নাম পাওয়া গেছে। সার্ভেয়ার মো: ফরিদ উদ্দিনের বাসা থেকে ৭ বস্তার বেশি সরকারি নথি উদ্ধার করা হয়েছে। যা অফিসে থাকার কথা। সার্ভেয়ারদের বাসা থেকে বেশকিছু চেকও পাওয়া গেছে। যা তাদের নামে নয়। সেগুলো বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ টাকার চেক এবং কিছু ব্ল্যাংক চেকও পাওয়া গেছে স্বাক্ষর করা। কারা, কেন এইসব চেক দিয়েছে তা পরবর্তী তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহন শাখায় অনেক ভূমি অধিগ্রহনের কাজ চলছে। দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে অভিযোগ করে আসছিল, এখানে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের গোয়েন্দা নজরদারী বাড়াই। নজরদারীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, এই ৩ জন সার্ভেয়ার এবং তাদের সাথে আরও অনেক কর্মচারী এবং কর্মচারীদের সঙ্গে অনেক দালাল জড়িত আছে। সার্ভেয়ারদের বাসায় আমরা বিভিন্ন অংকের টাকার হিসাব, কাকে কত টাকা দিত তাদের নাম-ঠিকানা পেয়েছি। হিসাব বিবরণীর বিভিন্ন নোট বুক এবং ডায়েরীও আমরা পেয়েছি। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এখনই অভিযুক্তদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। মহেশখালীর কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পসহ বহু প্রকল্পের অধীনে শত শত কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে এলএ অফিসের চেইনম্যান থেকে শুরু করে কানুনগো-সার্ভেয়ার পর্যন্ত ছোট-বড় অসাধু কর্মকর্তাদের চোখ এই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকার প্রতি। ভূমি অধিগ্রহণের বিপরীতে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য ভূমি মালিকরা এলএ অফিসে এলেই হয়রানি শুরু হয়। ভূমি মালিকদের অভিযোগ, এলএ অফিসে টাকা ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না। অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে ফাইল জমা দেওয়া থেকে শুরু করে চেক পাওয়া পর্যন্ত চলে টাকার খেলা। কাক্সিক্ষত টাকা না পেলে ভুয়া লোককে মালিক সাজিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল ও মামলা দিয়ে আটকে দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণের টাকা। নিরীহ ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ২০ থেকে ৩০ ভাগ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘ভূমি মালিকদের হয়রানি করার একটি সাধারণ ‘ফর্মুলা’ দেখা গেছে। তা হচ্ছে, একটি জমির মালিকানা কয়েকবার পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। তবে সর্বশেষ দলিলগ্রহীতা, নামজারি ও দাখিলা প্রদানকারীই হলেন জমির প্রকৃত মালিক। তাকে নোটিস করলেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। কিন্তু অধিগ্রহণ শাখা থেকে বিভিন্ন রেকর্ডীয় মালিকের কাছে নোটিস পাঠিয়ে বিষয়টি জটিল করে তোলা হয়। অনেকেই টাকার লোভে জমির প্রকৃত মালিক না হয়েও একে অন্যের বিরুদ্ধে আপত্তি দায়ের করেন। বর্তমান আইনে তখনই ক্ষতিপূরণের টাকা আটকে যায়। এর মাধ্যমে ঘুষের প্রথম অধ্যায় শুরু হয়।’

সরকারি নথি সার্ভেয়ারের বাসায় : গত বুধবার বিকেলে কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকায় সার্ভেয়ার মো: ফরিদ উদ্দিনের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব-১৫ এর একটি দল। ওই বাসায় ৭ বস্তারও বেশি সরকারি নথিপত্র পাওয়া যায়। ওই বাসাটিকেই অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন সার্ভেয়ার ফরিদ ও সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খান। সরকারি নথিগুলো ভূমি অধিগ্রহন শাখায় থাকার কথা থাকলে তারা তা বাসায় এনে রেখেছিলেন। অভিযানের সময় ফরিদ উদ্দিনকে পাওয়া না গেলেও নগদ ৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকাসহ মোহাম্মদ ওয়াসিম খানকে আটক করে র্যাব। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যমতে, ফরিদ উদ্দিনের শয়ন কক্ষের ফক্স হোল থেকে ৬১ লাখ ২০ হাজার ৫৫০ টাকা উদ্ধার করা হয়। ব্র্যাক ব্যাংকের দু’টো চেক, সিটি ব্যাংকের একটি চেক, ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি চেক পাওয়া গেছে ফরিদ উদ্দিনের বাসায়। সব মিলে প্রায় ১৫ লাখ টাকার চেক এবং বেশ কিছু ব্ল্যাংক চেক উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন র্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে আমরা কক্সবাজার শহরের তারবনিয়ারছড়া এলাকায় সার্ভেয়ার ফেরদৌস খানের বাসায় অভিযান পরিচালনা করি। সেখান থেকে শপিং ব্যাগের ভেতরে রক্ষিত অবস্থায় ২৬ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা উদ্ধার করি। সেখানেও আমরা বেশ কিছু চেক পাই। এবং বিভিন্ন এমাউন্টের হিসাবের হাতে লেখা কাগজ পাই। যেখানে তারা নিয়মিত কাদের কত টাকা দিতেন তার বিবরণ রয়েছে।’

কত টাকার মালিক ওয়াসিম : র্যাবের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খান বেশ কিছু লোকের নাম এবং ঠিকানা দিয়েছে। চেক দিয়েছেন-এমন কিছু ব্যক্তিকে নিজের আত্মীয় বলে দাবী করেছে ওয়াসিম এবং বলেছে, আত্মীয় হিসেবে তাদের সে টাকা ধার দিয়েছে। একরম সে দুই কোটি টাকার বেশি বিভিন্ন জনকে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘ওয়াসিম বিভিন্ন জনকে ২ কোটি টাকার বেশি ধার দিয়েছেন বলে দাবী করেছেন। একজন মানুষের কত কোটি টাকা থাকলে তিনি অন্যদের ২ কোটি টাকার বেশি ধার দিতে পারেন তা আমরা জানি না। অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসবে এই লোকগুলো তার আত্মীয় নাকি তাকে অবৈধ অর্থ দিয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওয়াসিমের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে করা দুদকের একটি মামলা আছে। তিনি যখন ঢাকায় জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহন শাখায় ছিলেন তখন মামলাটি হয়।’ তিনি জানান, সার্ভেয়ার ওয়াসিমের বাড়ি বরিশাল জেলা সদরের নবগ্রাম সড়কের মনসুর কোয়ার্টারে। তার পিতার নাম মো: দলিল উদ্দিন খান।

প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির বিপরীতে ভুয়া মালিকানা তৈরি করে ক্ষতিপূরণের প্রায় ২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জাফর আলম, সার্ভেয়ার কানুনগোসহ ১৩ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ২৩ জন স্থানীয় বাসিন্দাসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত নভেম্বরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতের জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয় জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহন শাখার ৫ জন সার্ভেয়ার ও একজন কানুনগোকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads