• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার মূলে সামাজিক-আইনি কাঠামো

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৩ অক্টোবর ২০২০

অপরাধ গবেষক ও নারী আন্দোলনের কর্মীরা দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিদ্যমান সামাজিক ও আইনি কাঠামোকে চিহ্নিত করেছেন। সেই সঙ্গে বিচার না হওয়ার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটাও অপরাধ বাড়িয়ে তুলছে বলে তাদের অভিমত। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ফৌজদারি অপরাধের অস্বচ্ছ ও বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়াও ধর্ষণ বাড়ার অন্যতম কারণ।

করোনা মহামারীর মধ্যেই সিলেট ও নোয়াখালীর দুটি ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করেছে। বিচার দাবিতে আন্দোলনের মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির মাত্রা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করেছে। এ নিয়ে অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করলেও একই সঙ্গে প্রশ্নও তুলেছে-শুধু মৃত্য্যুদণ্ড দিয়েই কি এ অপরাধ দমন করা সম্ভব?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ধর্ষণ বাড়ার অন্যতম কারণ-সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। যার বা যাদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা আছে, তারা সে দুর্বলতাকে ব্যবহার করছে। সমাজের যে প্রাতিষ্ঠানিক নিবেদন ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক সংগঠন- নানাভাবে আমাদের সংযত ও মানবিক হতে শিখিয়েছে। এখন তথাকথিত সামাজিক রূপান্তর এবং উন্নয়ন আধুনিকতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এ বন্ধনগুলো ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে। পাশ্চাত্যেও এমনটা হয়েছে। একদিকে আমাদের সামাজিক অনুশাসনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে এ জিনিসগুলো পেয়ে আমরা বেপরোয়া হয়ে ওঠছি।

সমাজের এ অস্থির পরিস্থিতিকে তিনি ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম অগবার্নের তত্ত্ব দিয়ে। পঞ্চাশের দশকে সেদেশের সামাজিক রূপান্তর নিয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তিনি-যেটি ‘কালচারাল লেক’ (সাংস্কৃতিক অসঙ্গতি) নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। অগবার্নের মতে, যখনই কোনো নতুন প্রযুক্তি সমাজে আসে মানুষ তখন খুব সহজেই তা গ্রহণ করে থাকে। তিনি এটাকে বলেছেন ম্যাটারিয়াল কালচার (বৈষয়িক সংস্কৃতি)। সমাজ পরিবর্তনের সময় প্রযুক্তি বা বৈষয়িক সাংস্কৃতিক উপাদান যত সহজে আমরা গ্রহণ করি, তার সঙ্গে অবৈষয়িক বা ভাবগত সংস্কৃতি-আদর্শ, মূল্যবোধ, নিয়ম, নীতি-নৈতিকতা তেমনভাবে গ্রহণ করি না। অজানা থেকে যায় প্রযুক্তি বা বৈষয়িক সংস্কৃতি কতটুকু, কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। ফলে আমরা বেপরোয়া, উন্মত্ত হয়ে ওঠি। বাড়তে থাকে অপরাধ।

অবাধ প্রযুক্তি, মাদক, পর্ণোগ্রাফির কারণে একজন পুরুষ তার যৌন প্রবৃত্তিটাকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে বলেই ধর্ষণসহ অপরাপর অপরাধ বাড়ছে। রাষ্ট্রের দুর্বলতা তুলে ধরতে গিয়ে বিদ্যমান ফৌজদারি অপরাধের বিচার কাঠামোকে দায়ী করেন তিনি। বলেন, আমাদের ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা রয়ে গেছে। পুলিশ, আদালত, প্রসিকিউশন ও কারাগার-এ চারটির মধ্যেই পুরুষতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক, উপনিবেশিক উপাদান বজায় আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাবানদের সেবা করার ক্ষেত্রে কাজ করছে। সাধারণ মানুষ বা অপরাধের শিকার ব্যক্তিকে সেবা না দেওয়ার মনোভাব তৈরি হয়েছে। ফলে একজন ভিকটিমকে সাপোর্ট দিতে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তার কিছুই এখানে নেওয়া হয় না।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুর মতে, সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীর প্রতি যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করা হয়, তাও ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের সমাজে ধর্ষিত নারীকেই দোষারোপ করা হয়। তার চালচলনকে দায় দেওয়া হয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নানাভাবে নারীকে হেয় করে বক্তব্য দেওয়া হয়। সমাজে নারীবিরোধী প্রচারণার কারণে আমরা তো পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছি না। এসব বিষয়কে জনগুরুত্বপূর্ণ বলে সামনে আনতে হবে। শুধু আইন ঘোষণা করে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না।

এছাড়া ধর্ষণ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সমাজে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না। রাজনৈতিক প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় অপরাধীরা দ্রুত জামিন পায়।  বের হওয়ার পর তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠছে।

ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের মামলাগুলো সুষ্ঠু-স্বচ্ছভাবে দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে পারলে এ অপরাধের হার কমে আসবে বলে মনে করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রথম নারী বিচারক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বলেন, বিচারটা করতে হবে তাড়াতাড়ি। বিচার যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঝুলিয়ে রাখলে হবে না। মৃত্যুদণ্ডের সাজার চেয়ে বিচার সুষ্ঠুভাবে দ্রুত করা প্রয়োজন।  সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় কিছুটা ভয় তো পাবেই। তবে ধর্ষণের সময় একজন ধর্ষক তো আর শাস্তির কথা চিন্তা করে না, এটাও আমাদের ভাবতে হবে। খালি শাস্তি বাড়লেই হবে না। বিচারপ্রক্রিয়া যাতে সুষ্ঠুভাবে তাড়াতাড়ি হয় সেটা দেখতে হবে।

আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মাদকের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন ঢাবির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন। আগে গ্যাংরেপ এতটা দেখি নাই। এর সঙ্গে মাদকের একটা যোগাযোগ আছে। বিশেষ করে সাইকেডেলিক ড্রাগ-যেগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নাই। ইয়াবাসহ যেসব মাদকের কথা আমরা শুনি এগুলো কিন্তু যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় এখন ধর্ষণের পর ধর্ষক আলামত গোপনে ধর্ষিতাকে মেরে ফেলার দিকে ঝুঁকতে পারে। আইনি কাঠামোর সংস্কার না করলে সমাধান আসবে না। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাধারণত যেসব অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় পৃথিবীর কোনো দেশেই সে অপরাধগুলো কমেনি। হতে পারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার কারণে ধর্ষণ কিছুটা কমে আসবে। তবে এটা একমাত্র সমাধান বলে আমার মনে হয় না। প্রশাসনকে বিশেষ করে পুলিশকে দলীয় কাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণেই অপরাধের বিচারের গোড়ায় গলদ তৈরি হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads