• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

ইরফানের ৭০ সদস্যের গ্যাং

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর ২০২০

সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের ছেলে কাউন্সিলর (বরখাস্ত) ইরফান সেলিমের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ পাচ্ছে। ৭০ সদস্যের এক শক্তিশালী গ্যাং আছে তার। ওয়াকিটকির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান যোগাযোগ রক্ষা করতেন ইরফান। নিজের চলাফেরার জন্য সব সময় পাশে রাখতেন ১২ জন দেহরক্ষী।

র্যাব বলছে, ইরফান সেলিমের অধিকাংশ দেহরক্ষীর অবৈধ অস্ত্র আছে। ব্যবহারের চেয়ে ভয়ভীতি দেখানোর কাজে ব্যবহার করা হতো এসব। অস্ত্রগুলো অবৈধ পথে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। গত মঙ্গলবার তার দেহরক্ষী জাহিদুলের কাছ থেকে এমনই একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব।

র্যাব সূত্র বলছে, দেহরক্ষীদের সঙ্গে নিয়মিত মদ পান করতেন ইরফান। ঘটনার দিন নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে যখন মারধর করা হয় তখনো তিনি মাদক সেবন করা অবস্থায় ছিলেন। মাতাল অবস্থাতেই মারধর করেন তিনি। ঘটনার পর বাসায় ফিরে ভুল বুঝতে পারেন ইরফান। মারধরের পরিণাম ভালো হবে না ভেবে আবার দাদাবাড়ির চারতলায় নিজের বারে ঢুকে সারারাত মদ পান করেন। অভিযান শুরু হলে র্যাবকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজের মদ পানের কথাও স্বীকার করেন। অভিযান চলাকালীন তার ডোপ টেস্ট করে র্যাব; যার রেজাল্ট পজিটিভ আসে।

পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক আধিপত্য ও দখলদারিত্বের নিয়ন্ত্রণে ইরফান ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সেন্টার গড়ে তোলেন।

তার কন্ট্রোল রুমে ছিল অত্যাধুনিক নেটওয়ার্কিং সিস্টেমের ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ডিভাইস। মদিনা আশিক টাওয়ারে এবং বাসার চার তলার নিজস্ব কক্ষে স্থাপন করেছিলেন ওয়াকিটকি বেজ স্টেশন। ইরফান ও তার সহযোগীরা ওয়াকিটকির মাধ্যমে চার বর্গকিলোমিটার এলাকায় যোগাযোগ করতেন। চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক আধিপত্য, দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সব ধরনের আলোচনার জন্য তার এবং বাহিনীর সদস্যদের জন্য ৩৮টি ওয়াকিটকি ব্যবহার করা হতো।

র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, দুই-তিন বছর আগেই পুরান ঢাকায় নিজস্ব বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ চালাতে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা তার বাসায় স্থাপন করেন ইরফান। গত কাউন্সিলর নির্বাচনের আগে মদিনা আশিক টাওয়ারের ১৭ তলায় ইরফানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ভিএইচএফ ডিভাইস ও একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এন্টেনা স্থাপন করেন। এসব ডিভাইস বিদেশ থেকে অবৈধ পন্থায় দেশে নিয়ে আসেন ইরফান। ভিএইচএফ ডিভাইসের মাধ্যমে কালো রঙের ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কোনো অনুমোদন ও লাইসেন্স ছিল না। নিজের আধিপত্য ও চাঁদাবাজি চালাতে অবৈধভাবে ওয়াকিটকি ব্যবহার করছিলেন ইরফান ও তার ক্যাডাররা।

র্যাব সূত্র জানায়, ইরফানের নিজস্ব ওয়্যারলেস ওয়াকিটকি নেটওয়ার্কে যোগাযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শনাক্ত করতে পারত না। এই অবৈধ সুযোগটি নিয়ে ইরফান অপকর্মের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি করতেন। এর জন্য ইফরান একটি ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেন। প্রত্যেকের কাছে ছিল অবৈধ অস্ত্র। এর মাধ্যমে পুরান ঢাকার জনমানুষের মধ্যে ভীতি প্রতিষ্ঠা করে রাখতেন। এর জন্য চক সার্কুলার রোডে মদিনা আশিক টাওয়ারের টপ ফ্লোরে ইরফানের একটি টর্চার সেল রয়েছে। যারা তার মতের বিরুদ্ধে যেতেন, তাদের ওই টর্চার সেলে এনে নির্যাতন চালাতেন এবং ভয়ভীতি দেখাতেন।

ইরফানের দেহরক্ষী ছিলেন ১২ জন। এদের মধ্যে জাহিদুল ইসলাম ছিলেন চকবাজারের ত্রাস। দেহরক্ষীদের সবার সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র থাকত বলেও তথ্য রয়েছে। আধিপত্যের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ ও হাজি সেলিমের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য বেতনভুক আরো ৩৫ জন ক্যাডার রয়েছে বলেও জানান র্যাবের কর্মকর্তারা।

র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ইরফান প্রতি রাতেই মদ্যপান করে তার দুটি বিদেশি কুকুর ও দেহরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে চকবাজার এলাকায় চক্কর দিতেন। পুরান ঢাকায় তাদের চলাচলে একটা আতঙ্ক বিরাজ করলেও ভয়ে কেউ কিছুই বলতেন না। পুরান ঢাকায় বিভিন্ন জমি দখলের বিষয়ে কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে র্যাব। হাজি সেলিম ও তার ছেলেরা পুরান ঢাকার কোনো জমি দখলের ক্ষেত্রে নিজেদের বেতনভুক ক্যাডারের পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করতেন। তাদের দখলদারিত্বে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ও সহায়তার জন্য চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) উপহারও দিয়েছেন তারা।

র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, নিজ বাসা ও তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ের ওপরে ভিএইচএফ ওয়াকিটকি বেজ স্টেশনটি মূলত এলাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিজের খরচে অবৈধভাবে এটি স্থাপন করেছিলেন ইরফান সেলিম।

তিনি বলেন, ইরফানের বাসা থেকে জব্দ হওয়া দুটি বিদেশি পিস্তল ও মাদকদ্রব্যের বিষয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় র্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি এবং দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে একই আইনে দুটি করে মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে নৌবাহিনীর কর্মকর্তার বাইককে ধাক্কা দেওয়া হাজি সেলিমের সেই ল্যান্ড রোভার গাড়িটির কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এই গাড়িটির ফিটনেস সনদ নেই। বছরের পর বছর চলে গেলেও বাধ্যতামূলক ফিটনেস পরীক্ষার ধার ধারেননি তারা। যদিও নিয়ম রয়েছে প্রতি বছর গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করে ছাড়পত্র নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুসারে ফিটনেস সনদ ছাড়া গাড়ি চালানো হলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড হতে পারে। গাড়ির ট্যাক্স টোকেন না থাকলে জরিমানা দিতে হবে ১০ হাজার টাকা।

এই গাড়ির মালিকের কাছে বিআরটিএর পাওনা হয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা। প্রতিটি যানবাহনকে ফিটনেস ছাড়পত্র নেওয়ার সময় রোড ট্যাক্স এবং অগ্রিম আয়কর জমা দিতে হয়। এই গাড়ির মালিককে প্রতি বছর রোড ট্যাক্স সাড়ে সাত হাজার টাকা এবং এর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে। সেইসঙ্গে প্রতি বছর অগ্রিম আয়কর হিসেবে ৭৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। ২০১০ সাল থেকে কাগজপত্র নবায়ন না করায় পাঁচ লাখের বেশি টাকা গাড়ির মালিক পরিশোধ করেননি। সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িটি ব্যবহার করছিলেন ইরফান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads