• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
রাজধানীতে সক্রিয় টোকাই ছিনতাইকারী গ্রুপ

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

রাজধানীতে সক্রিয় টোকাই ছিনতাইকারী গ্রুপ

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৬ জানুয়ারি ২০২১

সোমবার দুপুর। রাজধানীর শ্যামলী মোড়ে যানজটে আটকা গাড়ি। হঠাৎ দুজন ছিনতাইকারী সিএনজি অটোরিকশার ভেতরে থাকা এক নারীর ব্যাগ নিয়ে দৌড়। ছিনতাইয়ের শিকার ওই নারীর চিৎকারে কয়েকজন এগিয়ে গেলেও ছিনতাইকারী পালিয়ে যায়।

ছিনতাইয়ের শিকার নারীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস, থাকেন সাভারে। কাওরানবাজারের একটি ব্যাংকে আসছিলেন তিনি। তিনি জানান, ব্যাগে হাজার দুয়েক টাকা আর কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল। তবে তিনি এ ব্যাপারে থানায় কোনো অভিযোগ করেননি।

শুধু শ্যামলী নয়, রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে এ ধরনের টোকাই ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয়। বিশেষ করে শ্যামলী, আগারগাঁও, ফার্মগেট, মিরপুর ১০, কাজিপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, কাওরানবাজার, শাহবাগ মোড়, পল্টন, মতিঝিল, কাকরাইল, যাত্রাবাড়ি এলাকায় এরা বেশি সক্রিয়। প্রকাশ্যে দিনের বেলায় তারা নগরবাসীর ব্যাগ, মোবাইল ফোন ছিনতাই করে। অনেক সময় পুলিশের সামনেই পথচারী বা গাড়ির যাত্রীদের ব্যাগ, মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

পুলিশ বলছে, প্রকৃতপক্ষে এরা ভাসমান মাদকাসক্ত। ছিনতাইয়ের সময় ধরা পড়লে এমনিতেই গণধোলাই জোটে। তারপর থানায় নিয়ে গেলেও নানা সমস্যায় দেখা দেয়। এ কারণে থানায় নিয়ে আসার পর চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজধানী জুড়েই টোকাই ছিনতাইকারীরা সুযোগ বুঝে যানজটে দাঁড়ানো গাড়ির যাত্রীদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন, মহিলাদের স্বর্ণের চেইন ছিনতাই করছে। এদের বিরুদ্ধে পুলিশের কার্যত কোনো ভূমিকা না থাকায় প্রতিদিনই তারা বাস ও সিএনজি যাত্রীদের ব্যাগ, মোবাইল ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন এদের দৌরাত্ম্যে খানিকটা অসহায় হয়ে পড়েছে সিএনজি, বাসযাত্রী ও পথচারীরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, কাওরানবাজার এলাকায় মিজান ও রাসেলের নেতৃত্বের ১৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তারা পুরো কাওরানবাজার ও ফার্মগেট, এমনকী তেজগাঁও কলেজ পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আর সুযোগ পেলেই ছিনতাই করে। কাওরানবাজারের ছিনতাই গ্রুপের অন্যতম মিজানের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

মিজান জানায়, রাতের বেলাতে কারওয়ান বাজারে যে সবজির ট্রাক আসে। সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি নামিয়ে নেয় তারা। সে জানায়, সবজি বোঝাই ট্রাক যখন কারওয়ান বাজারে আসে সেই সময় সবজি নামিয়ে মালিক ব্যস্ত থাকে এই সুযোগে তখন সবজিগুলো তারা বস্তায় ভরে নিয়ে সটকে পড়ে। এছাড়া সুযোগ বুঝে লোকজনের হাতে থাকা ব্যাগ, মেয়েদের ব্যাগ, কানের দুল, চেইন, মোবাইল নিয়ে দৌড় দেয়।

মিজান আরো জানায়, শুধুমাত্র কারওয়ান বাজারে তাদের ১৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। যারা দিনের বেলাতে কারওয়ান বাজারের রাস্তার দুপাশে অবস্থান নিয়ে থাকে। এছাড়া তারা এফডিসি রোডেও মাঝে মাঝে অবস্থান নেয়। ছিনতাই করা মালামাল তারা বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেয়।

তেজগাঁও থানার ওসি সালাউদ্দীন মিয়া বলেন, এদের ধরা খুব মুশকিল। চোখের পলকে নাই হয়ে যায়। টোকাইরা খুবই সংঘবদ্ধ। এরা টার্গেট করে থাকে কখন গাড়ি সিগন্যালে পড়বে। ঠিক তখনই টার্গেট অনুযায়ী ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। তিনি বলেন, এরা অধিকাংশই মাদকাসক্ত। যার কারণে এরা মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে চুরি ছিনতাই করে।

তিনি বলেন, মাঝে মাঝে আমরা গ্রেপ্তারও করি। কিন্তু এরা যেহেতু মাদকাসক্ত তাই সুযোগ পেলেই এ কাজ করে থাকে। তবে রাস্তায় চলাচলের সময় সাবধানতা অবলম্বন করলে এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে টোকাই ছিনতাইকারীর বড় গ্রুপটি রয়েছে ফকিরারপুলে। এই গ্রুপটি ফকিরারপুল, শান্তিনগর, বিজয়নগর, গুলিস্তান, পল্টন এবং মতিঝিল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। দিনের বেলাতে এরা এই সব এলাকায় অবস্থান করলেও রাতে ফকিরারপুলের পানির ট্যাংকির কাছে জড়ো হয়। সেখান থেকে রাতেও তারা চুরি ছিনতাই করতে বের হয়।

জানা যায়, ফকিরারপুলের কিরন নামের টোকাই এ গ্রুপের নেতৃত্ব দেয়। তার নেতৃত্বেই এখানে টোকাইরা চলে। দিনে যে সব ছিনতাই করে সেগুলো তার কাছে জমা দেয়। এই গ্রুপটি পল্টন এলাকাতে হরহামেশাই ছিনতাই করে থাকে। এছাড়া মালিবাগ মৌচাক এলাকাতে এই টোকাই চক্রের বেশ কয়েকটি গ্রুপ চুরি ছিনতাই করে আসছে বলেও জানা যায়।

ভুক্তভোগীরা জানান, বাস অথবা সিএনজিতে যাওয়া যাত্রীদের ব্যাগ, মোবাইল ও চেইন ছিনতাই ছাড়াও এরা গাড়ির লুকিং গ্লাস, মোটরসাইকেলের সাথে থাকা হেলমেটও চুরি করে। পল্টন, মতিঝিল এলাকায় গাড়ির লুকিং গ্লস ও হেলমেট চুরির প্রবণতা বেশি বলে জানা গেছে।

এদিকে টোকাই চক্রের চুরি ছিনতাই প্রবণতা বিষয়ে মতিঝিল থানার ওসি ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, টোকাইরা এই ধরনের কাজ করে থাকে। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়না। প্রথমত, কেউ তাদের মামলা করেনা। আবার থানায় নিয়ে আসলেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও এরা মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে আমরা ঝমেলায় পড়ি। ধরা পড়ার সময় এমনতিইে গণধোলাই খায়, এরপর পুলিশ তাদের চড় থাপ্পড় দিয়ে আর এই সকল কাজ না করার শর্তে ছেড়ে দেয়। পরে তারা আবারো করে। তিনি বলেন, তারপরও আমরা এটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।

পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমরা টোকাই চক্রের অপরাধ রোধে সচেষ্ট রয়েছি। তাদের নিয়ে কিছু ঝামেলা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধরা পড়ার  পর মারধর দিয়ে সাধারণত এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে তারা আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এদের বিরুদ্ধে সুনির্ির্দষ্ট কোনো মামলা হয়না।

রমনা থানার ওসি মনির হোসেন বলেন, টোকাই নিয়ে আমরাও সমস্যাই থাকি। বেশিরভাগ সময় রাতের বেলাতে এরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে। তিনি বলেন, টহল টিমকে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে যখনই কোনো টোকাই এ ধরনের কাজ করবে তখন তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসতে  হবে। এছাড়াও গতিবিধি সন্দেহ হলেও তাকে থানায় নিয়ে আসার নির্দেশ রয়েছে ।

সার্বিক বিষয়ে ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) আবিদ হাসান বলেন, টোকাইরা মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে এরা চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এদের নিয়ে আইনগত কিছু সমস্যাও রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারপরও এদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর প্রত্যেকটি থানাকে কঠোর  নির্দেশ দেওয়া রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads