• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ-তরুণীরা

হাইকোর্টে রিট নীতিমালা না থাকায় অপব্যবহার

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০২১

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও, লাখ লাখ ভিউ। রঙিন এক দুনিয়া। বড় বা ছোট পর্দা নয়। কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও চলে যাচ্ছে নেট দুনিয়ার লাখ লাখ মানুষের কাছে। আর তাতেই নিজেকে স্টার ভাবা। বলছি লাইকি ও টিকটকের কথা। নিজেকে স্টার তৈরি করার জন্য স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা টিকটক ও লাইকিতে ঝুঁকে পড়ছে। টিকটক ও লাইকির ভালো ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু স্টার বানানোর ফাঁদে ফেলে ঘটছে ভয়ংকর কিছু ঘটনা। বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনা।

ইতোমধ্যে টিকটক-লাইকি বন্ধে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। যার আদেশ এখনো আসেনি। আর সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরনের সংস্কৃতির সাথে শিশুরা যদি অভ্যস্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ অসুস্থভাবেই চলবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,  দেশে হাজার হাজার তরুণ -তরুণী এখনো লাইকি ও টিকটকে আসক্ত। নানা ধরনের যৌন উত্তেজক কথা বলে অনেকে টিকটক বানায়। আবার অনেকে বাংলা-হিন্দি গানের সঙ্গে নাচ করে টিকটক, লাইকি বানায়। আবার অনেকে লাইকিতে লাইভে আসে। আর লাইভে কেউ ভালো কথা বলে, কেউ যৌনতা নিয়ে কথা বলে। অনেক সময় তরুণীদের পোশাকও নগ্নতায় ভরা থাকে। তাদের নিকট এটি একটি রঙিন দুনিয়া। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও লাখ লাখ ভিউ হয়ে যায়। এতে করে তারা নিজেদের স্টার মনে করে। আর স্টার হওয়ার নেশায় নিজের অজান্তেই সুযোগ-সন্ধানীদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। অনেকে এটিকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদ পাতে। আর এ পাতা ফাঁদে পা দিয়েই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে তরুণীরা। পার্টির আড়ালেও টিকটকারদের বিরুদ্ধে তরুণীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানোরও অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, টিকটকের কথিত মডেল দেওয়ান রসুল হূদয়কে চার ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকা থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সে বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করে তা টিকটক ও লাইকিতে আপলোড করত। সেখানে অভিনয়ের ফাঁদে ফেলে একে একে চার ছাত্রীকে নিজের বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পাশবিকতার শিকার তিনজন কলেজ এবং একজন স্কুলের ছাত্রী। তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকে। গ্রেপ্তার হূদয় একজন ক্রমিক ধর্ষক (সিরিয়াল রেপিস্ট)। পুলিশ আরো জানায়, হূদয় গত ১২ সেপ্টেম্বর নিজের বন্ধুদের নিয়ে গাজীপুরের একটি রিসোর্টে পার্টির আয়োজন করে। সেখানে পরিচয়ের সূত্রে দুই কলেজ শিক্ষার্থী মডেল হওয়ার আগ্রহ দেখায়। এর দুদিন পর হূদয়ের এক বান্ধবীর মাধ্যমে তারা কুড়িলে হূদয়ের বাসায় আসে। টিকটকের শুটিং শুরু হওয়ার কথা বলে তাদের ওই বাসার নিচতলার একটি কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়। এরপর ওই ছাত্রীদের ওপর পাশবিকতা চালায় সে।

হূদয়ের ফেসবুকে ‘টিকটক ও লাইকিতে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে’-এমন বিজ্ঞাপন দেখে গত ২০ সেপ্টেম্বর আরো দুই শিক্ষার্থী হূদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদেরও হূদয় শুটিংয়ের কথা বলে নিজের বাসায় থাকতে দেয়। পর দিন সকালে তাদের মধ্যে একজনকে বাসার তৃতীয় তলায় নিয়ে পাশবিকতা চালানো হয়। ওই রাতেই আরেক শিক্ষার্থীর ওপর চলে পাশবিকতা। এভাবে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার শিক্ষার্থীকে নিজের বাসায় আটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে হূদয়।

ভাটারা থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান জানান, হূদয়ের টার্গেট ছিল রঙিন দুনিয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণী ও কিশোরীরা। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ওই মেয়েদের ধর্ষণ করে সে।

এছাড়াও গাজীপুরে ‘টিকটক স্টার’ বানানোর প্রলোভনে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

স্বজনদের বরাত দিয়ে টঙ্গী থানার এসআই জিয়া জানান, ওই কিশোরীর বাড়ি গাজীপুরে। ২৩ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় সে। ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী পূর্ব থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তার পরিবার। শনিবার অভিযান চালিয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়।

ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোনে টিকটক বানানোর শখ। সেখান থেকে ফেসবুকে কয়েকজন টিকটক বন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিশোরীটিকে টিকটক স্টার বানানো হবে এমন কথা বলে বাড়ি থেকে বের করে নেয় ওই বন্ধুরা। এরপর তাকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। সেখানে টানা তিন দিন আটকে রেখে চালায় পাশবিক নির্যাতন।

এসআই জিয়া আরো বলেন, মেয়েটিকে টিকটক স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার গ্লোরিয়ায়। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে শিশির, শাওন, জুনায়েদসহ অজ্ঞাতনামা আরো একজন তাকে ধর্ষণ করে। মেয়েটির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, শিশির ও জুনায়েদকে ঢাকার ওয়ারী থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন টিকটকার বলেন, বর্তমানে টিকটক, লাইকিতে স্টার হওয়ার জন্য কিছু তরুণী উদগ্রিব। আর এটির সুযোগ নিচ্ছে সুযোগ-সন্ধানীচক্র। শুটিংয়ের নামে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে এ ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। অনেকে লজ্জায় বা মান-সম্মানের ভয়ে থানা পুলিশ করতে চায় না।

তারা আরো জানায়, অনেক সময় পার্টির নামেও চলে অনৈতিক কাজ। কিছু তরুণ -তরুণী সারা দিনই টিকটক ভিডিও বানাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার কারণে এটি আরো বেড়েছে বলেও জানান তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, টিকটক ও লাইকির মতো অ্যাপসগুলো ইতিবাচক কাজের জন্য তৈরি হলেও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সামাজিক শিষ্টাচারের ঘাটতি থাকায় আমরা বরাবরের মতো নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করছি। এর প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের গ্যাংভিত্তিক কিশোর অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের পোশাক, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, চুলের কাটিং কেমন হবে—সে বিষয়ে পরিবার ও সমাজের নজরদারি থাকা উচিত।  এছাড়া পরিবারবঞ্চিত শিশু-কিশোর ও তরুণদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এগিয়ে এলে অপরাধ হ্রাস করা সম্ভব হবে। 

এদিকে টিকটক, লাইকি, বিগো লাইভ অ্যাপস বন্ধ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে আর খান রবিন। গত ৩০ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিটটি দায়ের করেন তিনি। রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, তথ্য সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে বিবাদী করা হয়েছে।

জে আর খান রবিন জানান, এই অ্যাপসগুলোর ফলে যুবসমাজ বিপথে যাচ্ছে। টিকটকের ফাঁদে পড়ে অনেকের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। এসবকে কেন্দ্র করে অপরাধপ্রবণতাও বাড়ছে।

এর আগে গত ৮ অক্টোবর বিগো লাইভ, টিকটক ও লাইকি নামের মোবাইল ফোন অ্যাপ ব্যবহারে তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হওয়ায় এসব অ্যাপ বন্ধ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি আইনি নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জে আর খান রবিন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয় সচিব এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে এ নোটিশ পাঠানো হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সবাই ভালো কাজ করুক এটি আমরা চাই। ভালো কাজে আমরা সবসময় উৎসাহিত করি। কিন্তু কেউ যদি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে খারাপ কাজ করে তবে আমরা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি। আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ প্রযুক্তির কল্যাণে ভালো কিছু করুক এটি সবসময় প্রত্যাশা করি। তবে কেউ যদি এর বাইরে গিয়ে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় তাদেরও ছাড় দিই না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads