• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

এবার রাজধানীতে ৮৫ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার

পাচারের আন্তর্জাতিক রুট বাংলাদেশ

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৯ জানুয়ারি ২০২১

সাপের বিষের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশ। ফ্রান্স থেকে আন্তর্জাতিক পাচার চক্র বিষ আনে বাংলাদেশে। এ দেশ থেকে হাতবদল হয়ে চলে যায় ভারতে। আর সেখান থেকে শেষ গন্তব্য হিসেবে চলে যায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়।

ওষুধ তৈরিতে ব্যবহূত সাপের বিষ বাংলাদেশে কেনাবেচার অনুমতি নেই। তবু একটি চক্রের হাত ধরে বাংলাদেশে ঢুকছে এ বিষ। কোটি কোটি টাকা দামের এই বিষের রয়েছে বৈশ্বিক বাজার। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় সাপের বিষের চাহিদা বেশি। এ কারণে রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাচার হচ্ছে।

গত দুই মাসে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার সাপের বিষয় উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বনশ্রী থেকে ৮৫ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল হায়দার বলেন, দেশের বাইরে থেকে এই সাপের বিষ কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশে এসেছে। দুই-তিন হাত ঘুরে হয়তো এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার হতো। সাপের বিষ ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। তবে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালে এটি ব্যবহারের বৈধতা নেই। যে কারণে এটি বাংলাদেশের ব্যবহারের সুযোগও নেই। আমরা এখনো নিশ্চিত না যে এটা ঠিক কোন দেশ থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এটা এলসির মাধ্যমে আনা হয়নি। জব্দ করা কনটেইনারগুলোতে লেখা আছে ‘মেড ইন ফ্রান্স’।

তিনি বলেন, দেশে সাপের বিষ বেচাকেনার কোনো সুযোগ নেই। তাই সাপের বিষ পাচারের জন্য বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে পাচারকারীরা। বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাপের বিষ পাচার হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। কারণ বিশ্ব বাজাো এটার চাহিদা আছে। তবে সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহূত হচ্ছে বলে মনে করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা বনশ্রীতে অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ ৫ জনকে আটক করি। তিনি বলেন, র্যাব-৪ এ অভিযান পরিচালনা করে। আটককৃতরা সাপের বিষের আন্তর্জাতিক চোরাকারবারির সদস্য। তারা পাচারের উদ্দেশ্যে ওই বাসায় এগুলো জমা রেখেছিল।

কোথা থেকে আসে বিষ, যায় কোথায়

র‍্যাবের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ হলেই এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। তবে আমরা যেগুলো উদ্ধার করেছি সেগুলোর প্যাকেটের ধরন দেখে মনে হচ্ছে বাইরে থেকে এসেছে। আর জারগুলোতে লেখা ছিল মেড ইন ফ্রান্স।

এর আগে গাজীপুরে বিষ উদ্ধারের পর সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বলেছিলেন, তারা যে বিষ উদ্ধার করেছিলেন তার জারগুলোতেও মেড ইন ফ্রান্স লেখা ছিল।

তিনি তখন বলেছিলেন, পাচারকারীরা সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে আসছে। শেখ মো. রেজাউল হায়দার অবশ্য বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিষ পাচার হয়। আবার কখনো সেসব দেশ থেকে এনেও অন্য দেশে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের আইনে সাপের বিষের লেনদেন বা কেনাবেচা এবং পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা বছরে অন্তত একশ কোটি টাকা মূল্যের বিষ পাচার হয় বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে।

ফেনী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লাসহ কয়েকটি এলাকায় বেশ কয়েকটি চক্র গড়ে উঠেছে যারা সাপের বিষ সংগ্রহ ও চোরাচালানের সাথে জড়িত বলে পুলিশের ধারণা।

ওষুধে ব্যবহার হয়?

বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার করে না। তবে ২০১৭ সাল থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

প্রকল্পের জরিপের কাজ অর্থাৎ দেশি সাপের প্রায় সব ধরনের প্রজাতির ওপর জরিপ চালানো শেষ হয়েছে। এ ছাড়া সবচেয়ে বিষধর সাপের প্রজাতি সংগ্রহ এবং সেগুলোর লালনপালনের জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও চলছে। বিষধর সাপের জীবনযাপন ও দংশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি জানার পরই অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজটি সফল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ নভেম্বর গাজীপুর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ কয়েকজনকে আটক করেছিল পুলিশের আরেকটি সংস্থা সিআইডি। পরে ২৬ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন।

এর একমাস পর ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ ছয়জনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২)। আটককৃতরা হলেন- মাসুদ রানা (২৪), ছফির উদ্দিন শানু (৫০), তমজিদুল ইসলাম মনির(৩৪), আলমগীর হোসেন (২৬), ফিরোজা বেগম (৫৭) ও আসমা বেগম (৪২)।

ওই সময় র্যাব-২ এর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছিলেন, আটকদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে কাচের জারে রক্ষিত বিপুল পরিমাণ সাপের বিষ পাওয়া যায়, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া তাদের কাছ থেকে সাপের বিষ সংক্রান্ত সিডি এবং বিষের ম্যানুয়াল বই উদ্ধার করা হয়।

আটকরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য। এছাড়া তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর এক মাস পার হতে না হতে ৮ ডিসেম্বর উদ্ধার হলো ৮৫ কোটি টাকার বিষ। আর এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে ৫ জনকে।

তারও আগে চলতি বছরেই জুন মাসে ফেনীতে দুই পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিল র‍্যাব। এর আগে কয়েক বছর ধরে সাপের বিষ উদ্ধারের খবর নিয়মিতই পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকেই ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। তখন যার মূল্য ছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। তার আগের বছর চুয়াডাঙ্গা থেকে ১২ কোটি টাকা মূল্যের বিষ উদ্ধার করা হয়েছিল।

অন্যদিকে ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধারের ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তখন সেখানকার কর্মকর্তারা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এগুলো বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads