• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে বাড়ছে খুনোখুনি

সপ্তাহের ব্যবধানে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে দুই খুন

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২১

কিশোর গ্যাংয়ে খুনোখুনি বাড়ছেই। পুলিশের নানা উদ্যোগের পরও কমছে না কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। এ বছরের প্রথম দিনেই রাজধানীর মহাখালীতে খুনের ঘটনা ঘটে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই কামরাঙ্গীরচরে ঘটে আরেক খুনের ঘটনা। পুলিশ দুই খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু রাজধানীজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীতে প্রায় ৪০টি কিশোর গ্যাং বেপরোয়া বলে জানা গেছে। খোদ পুলিশ প্রধান (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ কিশোর গ্যাং বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন।

পুলিশের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা থামাতে তারা মাঠে কাজ করছেন। সচেতনতা বাড়ানো থেকে শুরু করে অপরাধী কিশোরদের নিয়ে আইনের আওতায় কাজ করে যাচ্ছেন। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, নিজেদের সিনিয়র বলে প্রতিষ্ঠার প্রবণতা থেকেই এই গ্রুপগুলো তৈরি হয়েছে। লেখাপড়া না করা কিশোরদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছেলেরাও রয়েছে। দলগুলোর প্রধানরা বয়সে বড়। উত্তরার বিগ বস, মাইরা ফালাইমুসহ কয়েকটি গ্রুপের লিডাররা বয়সে বড়। আবার অনেকে স্বার্থ হাসিলের জন্য এদের ব্যবহার করে। হাতে ইয়াবা, বাইক দিয়ে জমি দখলে নিয়ে যায়। লোকবল বাড়ায়। এসব কারণেই কিশোর গ্যাং পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি দুটি খুনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমাতে মাঠে কাজ করছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর মহাখালীতে আরিফ নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুন করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় হাসান ও সোহাগ নামে আহত হয়েছে আরো দুজন। কাঁচাবাজারের সামনেই আরিফসহ তিনজনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে কয়েকজন কিশোর। পরে তাদের বন্ধু রবিনসহ অন্যরা ওই তিনজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরিফকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত হাসান ও সোহাগ এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ নূরে আজম মিয়া বলেন, নিজেদের মধ্যে মাদক সেবনের দ্বন্দ্বের জের ধরে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। তারা সবাই বয়সে কিশোর ও মাদকাসক্ত। এ ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তাররা সবাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কামরাঙ্গীরচর থানার করিমাবাদ সরকারবাড়ি এলাকায় গ্রেপ্তারদের সাথে রিফাত (১৪) -এর সাথে গায়ে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে বািবতণ্ডা হয়। বািবতণ্ডা শেষে রিফাত ইব্রাহিমনগর বালুর মাঠ বরিশাইল্যা গলিতে গেলে পুনরায় রিফাতের সাথে বাকবিতণ্ডা শুরু করে। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে গ্রেপ্তাররা ভিকটিমকে এলাপাতাড়ি মারপিট ও ছুরিকাঘাত করে। এতে সে গুরুতর জখম হয়। স্থানীয় ভ্যানচালক ভিকটিমকে প্রথমে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তারের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় রিফাতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে।

কামরাঙ্গীরচর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তাররা সবাই সংঘবদ্ধ কিশোর। এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমাতে নানা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি অপরাধে যুক্ত কিশোরদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

এর আগে বছরের শেষের দিকে সাভারে স্কুলছাত্রী নীলা রায় হত্যা ও তার আগে রাজধানীর উত্তরখানের সাকিব হত্যার পর দীর্ঘদিন পর আবারো আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। ধারণা করা হচ্ছে, কিশোর গ্যাং গ্রুপ ক্রমেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।

জানা যায়, নীলা হত্যার মূল আসামি মিজানুর রহমান ও তার দুই সহযোগীকে পুলিশ এরই মধ্যে আটক করেছে। দীর্ঘদিন ধরে মিজানুরের নেতৃত্বে ওই এলাকায় একটি কিশোর গ্যাং অপরাধ করে আসছিল। তারা মাদক ব্যবসায়ও যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর নীলাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।

এর আগে রাজধানীর উত্তরখানে সাকিব নামের এক যুবককে এলোপাতাড়ি ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। নিহতের নাম সোহাগ (২০)। গত বছরের ২৮ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তরখানের রাজাবাড়ি খ্রিস্টানপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত তরুণ উত্তরা কমার্স কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। হত্যায় জড়িতরা এলাকায় মাদকের কারবারে যুক্ত বলে দাবি করেছেন নিহতের স্বজনরা। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে আটক করে পুলিশ।

উত্তরখান থানার ওসি হেলাল উদ্দিন বলেন, তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে যায়। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৪ জনকে আটক করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু ঢাকায়ই বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে তারা ঢাকায় অন্তত ৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর মধ্যে উত্তরার কিশোর গ্যাং সবচেয়ে আলোচিত। সেখানে একাধিক গ্যাং রয়েছে। উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির। তার পরের মাসে তেজকুনিপাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক। নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ইস্পাহানী ঘাটে স্থানীয় দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় দুই স্কুলছাত্র। কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসুলপুর ৬ নম্বর গলিতে ছুরিকাঘাতে খুন হয় সজীব নামের এক তরুণ। হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় হাসনাত শিপন নামের এক তরুণ। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে মুগদায় মান্ডার ল্যাটকার গলি বালুর মাঠে ছুরিকাঘাতে খুন হয় তরুণ মাহিন হোসেন। ১৮ নভেম্বর মিরপুরের শাহ আলী স্কুলের পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আহত হয় শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিফাত ও শাহেদ।

জানা গেছে, গত বছর ঢাকায় র্যাব-পুলিশের ব্যাপক অভিযানে অন্তত ৩০টি কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তখন শনাক্ত হওয়া ৬২টি গ্রুপের মধ্যে অন্তত ৪০টি এখনো সক্রিয়। করোনা মহামারীর মধ্যেও হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলোচনায় ছিল কিশোর গ্যাং।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজেদের সিনিয়র ও প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত করতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, বাইক রাইডিং, অনলাইন ক্যাম্পিং, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে গ্যাংগুলো গড়ে উঠছে। এরপর মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, দল বেঁধে মাদকসেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্রুপ। প্রতিটি দলে ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অন্তত ১০-১৫ জন করে থাকছে। তবে দলনেতার বয়স তাদের চেয়ে বেশি, ১৮ থেকে ২৫ বছর। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে অপরাধ করতে মহল্লার বড় ভাই এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব দলনেতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাদের হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এবং দখল ও চাঁদাবাজিতে দল ভারী করে উঠতি বয়সি এই অপরাধীরা। বস্তির দিনমজুর থেকে শুরু করে ধনীর দুলালরা এই চোরাবালিতে নিজের অজান্তেই পা দিচ্ছে।

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্লেষক ড. কুদরাত-ই খুদা বাবু বলেন, শিশু-কিশোররা অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে হিরোইজম বা নিজেকে বড় মনে করা একটি বড় কারণ। এ ছাড়া অভিভাবকদের উদাসীনতা, বেড়ে ওঠার অসুস্থ পরিবেশ এবং অনলাইনের অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয় দায়ী। তবে এর প্রতিকারে আইনের প্রয়োগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। সংশোধন ব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কিশোররা দেখে অপরাধীরা হিরো। তারা দেখে বড়রা নানা অপরাধ করে ক্ষমতাবান হচ্ছে। ফলে তারাও সেই পথে যায়। তারা গ্যাং গঠন করে। নিজেকে ক্ষমতাবান করতে চায়। হিরো হতে চায়। গড়ে তোলে কিশোর গ্যাং।’

এদিকে গতকাল সোমবার র্যাবের অনুষ্ঠানে গিয়ে কিশোর গ্যাং নিয়ে কথা বলেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা যেন আইনের আধুনিকায়ন করতে গিয়ে জটিলতা তৈরি না করি। পত্রিকার পাতা খুললেই কিশোর গ্যাং। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক শিশুদের হেফাজতে নিতে হলে নানা ধরনের নিয়ম রয়েছে। তাদের বিচার শিশু আদালতে করতে হবে। আমাদের দেশে কয়টি শিশু আদালত রয়েছে? শিশুদের ধরে আনলে রাখতে হবে সংশোধনাগারে। কিন্তু সংশোধনাগার কয়টি আছে? তবে কী আমরা কিশোর গ্যাং ও শিশু অপরাধীদের গ্রেপ্তার করব না? শিশু আদালত নেই, তাতে কী বিচার হবে না? হবে, সবকিছুই করতে হবে। তবে শিশুদের সচেতনতার জন্য পরিবাবকে দায়িত্ব নিতে হবে। এটি বাবা-মার সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্বও বটে।

বেনজীর আহমেদ বলেন, এসব কিশোর গ্যাংকে মোকাবিলা করতে হবে। সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এ কিশোর-কিশোরীরাই কিন্তু আগামী দিনের বাংলাদেশ। তথা ২০৪১ সালের ধনী দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। সেই শিশুরা ড্রাগ নিয়ে কিংবা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে ধ্বংস হয়ে যাক সেটা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। সেই জন্য আমাদের সমাজ ও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের বয়সি সবাই শিশু। মানবাধিকার ও এনজিওকর্মীরা হইচই করে অনেক আইন পরিবর্তন-সংশোধন করেছেন। আমাদের আধুনিকায়ন দরকার আইজিপি হিসেবে আমি দ্বিমত পোষণ করি না। তবে অত্যাধুনিক আইন করতে গিয়ে আমরা দেশের মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি করছি কি না সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads