• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

মূল্যহীন বস্তুতে মূল্যবান ট্যাগ

উদ্ধার হওয়া সাপের বিষ ও ইউরেনিয়াম ভুয়া

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২০ জানুয়ারি ২০২১

মূল্যবান বস্তু দেখিয়ে নিখুঁত প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। কিন্তু বাস্তবে মূল্যহীন এসব বস্তুতে বিশাল দামের ট্যাগ লাগিয়ে এমন প্রতারণা করা হচ্ছে। যারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারাও সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে নিজেদের প্রকাশ করতে চান না। রাজধানীর অভিজাতকেন্দ্রিক এলাকায় এ প্রতারণার জাল লক্ষ করা গেছে।

প্রতারণার এ বস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম সাপের বিষ, ইউরেনিয়াম ও সীমান্ত পিলার অন্যতম। পুলিশ যতবার-ই এসব উদ্ধার করেছে ততবারই এগুলো ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। সর্বশেষ ৫৫ কোটি টাকার ইউরেনিয়াম উদ্ধারের বিষয়টি মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার হলেও সর্বশেষ এটিও ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সাপের বিষের মূল্য কোটি টাকা, ইউরেনিয়ামেরও তাই। প্রথমে এগুলো সেই সাদৃশ্য হলেও পরে এগুলো ভুয়া বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, বস্তুগুলো মূলত প্রতারণার কাজেই ব্যবহূত হচ্ছে। এ প্রতারকরা কাদের নিকট এগুলো দিয়ে প্রতারণা করে সেটি টার্গেট করে ব্যাপক অনুসন্ধানে নেমেছে গোয়েন্দারা। তবে যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা এ বিষয়ে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেননা।

সাপের বিষ :  সাপের বিষ খুবই মূল্যবান বস্তু। বাংলাদেশের আইনে সাপের বিষের লেনদেন বা কেনাবেচা এবং পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। আবার অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশ থেকে সাপের বিষ ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া পাচার হয়। আর পাচারকারীরা আনে ফ্রান্স থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্ধার হওয়া সাপের বিষ টেস্টে এখনো প্রমাণিত হয়নি। এগুলো ভুয়া বস্তু বলেই প্রমাণিত।

গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকার সাপের বিষসহ দুজনকে গ্রেপ্তারের দাবি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরই মধ্যে সিআইডির ল্যাবে পরীক্ষার পর বেরিয়ে এসেছে, জব্দ করা আলামত সাপের বিষ ছিল না।

এর একমাস পর ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ ছয়জনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২)। ওই সময় র্যাব-২ এর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছিলেন, আটকদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে কাচের জারে রক্ষিত বিপুল পরিমাণ সাপের বিষ পাওয়া যায়, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া তাদের কাছ থেকে সাপের বিষ সংক্রান্ত সিডি এবং বিষের ম্যানুয়াল বই উদ্ধার করা হয়।

আটকরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাচালানচক্রের সক্রিয় সদস্য। এছাড়া তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি রামপুরার চৌধুরীপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ৮৫ কোটি টাকার সাপের বিষসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র্যাব-১২।

তারও আগে চলতি বছরেই জুন মাসে ফেনীতে দুই পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিল র‍্যাব। এর আগে কয়েক বছর ধরে সাপের বিষ উদ্ধারের খবর নিয়মিতই পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকেই ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। তখন যার মূল্য ছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। তার আগের বছর চুয়াডাঙ্গা থেকে ১২ কোটি টাকা মূল্যের বিষ উদ্ধার করা হয়েছিল।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, প্রথম অভিযানে উদ্ধার করা নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, সেগুলো সাপের বিষ নয়। পরের অভিযানের নমুনা এখনো পরীক্ষা করা হয়নি। তবে উদ্ধার করা বস্তু সাপের বিষ না হলেও জড়িতরা অপরাধ করেছেন। তারা ওই বস্তুকে সাপের বিষ বলে বিক্রি করে লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করছিলেন। এ অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সিআইডির সূত্র বলছে, যেহেতু এখন পর্যন্ত টেস্টে সাপের বিষ প্রমাণিত হয়নি সেহেতু টেস্টের অপেক্ষায় থাকাগুলো বিষ বলে প্রমাণিত না হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

ইউরেনিয়াম : ইউরেনিয়ামও অতিমূল্যবান বস্তু। এটিও নিয়ে প্রতারণায় জড়িয়েছে প্রতারকচক্র। গত ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর রামপুরায় ৫৫ কোটি টাকার ইউরেনিয়ামসহ ৩ জনকে আটক করে র্যাব। ঘটনাটি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। র্যাব প্রাথমিক অবস্থায় রামপুরা থানায় জিডি দায়ের করে তা পরীক্ষার জন্য নমুনা পরমাণু শক্তি কমিশনে পাঠায়।

পরবর্তীতে রামপুরা থানার তদন্ত ও পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষায় তা ইউরেনিয়াম নয় বলে প্রমাণিত হয়। ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব না পাওয়ায় রামপুরা থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রেজাউল করিম গ্রেপ্তারকৃত ৩  আসামির অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন।

এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বনানী থেকে একই সদৃশ্য বস্তু জব্দ করেছিল। ওই সময় ইউরেনিয়াম বলেও প্রচার করা হয়েছিল। আটক করা হয়েছিল ১১জনকে। ওই সময় ডিবির উদ্ধার আর র্যাবের উদ্ধার করা বস্তুটির প্যাকেটের গায়ে যা লেখাছিল সেটি হুবুহু। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ওই সময়ে তদন্তে অনেক গভীরে যায়। পরবর্তীতে এটি পরীক্ষা করে  ইউরেনিয়াম নয় বলে প্রমাণিত হয়।

রামপুরা থানার অফিসার্স ইনচার্জ শাহিন ফকির বলেন, র্যাবের ইউরেনিয়াম বলে দেওয়া আলামত পরীক্ষার পর এর রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। এ বিষয়ে আমরা আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছি। পাশাপাশি এ ঘটনায় যারা গ্রেপ্তার ছিলেন তাদের অব্যাহতি দেওয়ারও আবেদন করা হয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, রাজধানীর বনানী, গুলশানকেন্দ্রিক এ ধরনের চক্র রয়েছে। যারা কোটি টাকা দামের ইউরেনিয়াম বলে প্রচার করে প্রতারণা করে। চক্রটি অনেক ধূর্ত ও চালাক প্রকৃতির। এরা কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করে। যারা প্রতারণার শিকার হন তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে অভিযোগও করেন না। এ কারণে চক্রটিকে গ্রেপ্তারও করা যায় না।

সীমানা পিলার : ব্রিটিশ আমলের সীমানা পিলার নিয়েও জনশ্রুতি রয়েছে। কিছু লোকজন ধারণা করেন সীমানা পিলারের মূল্যও কোটি কোটি টাকা। সেখানে ইউরেনিয়াম জাতীয় বস্তু রয়েছে। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকাগুলো থেকে সীমানা পিলার উদ্ধারের ঘটনাও রয়েছে। পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে সেগুলোও ভুয়া।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, একশ্রেণির প্রতারক রয়েছে যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত। অত্যন্ত সুকৌশলে কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে তারা এগুলো করে থাকে। এটা কেনা মানে প্রতারিত হওয়া। যারা প্রতারিত হন তারা বলেন না। যার কারণে এই চক্রকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তবে মাঝে কিছু আমাদের মাঝে ধরা পড়ে কিন্তু এর গভীরে যাওয়া যায় না।

কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডির কিছু এলাকাকে ঘিরে এসব প্রতারকচক্র ফাঁদ পাতে। আর এদের টার্গেট হলো সেই ধরনের ব্যক্তি যারা আসলে এগুলো কিনতে পারবে। যারা এগুলো কেনে তারাও তো পরীক্ষার কোনো সুযোগই থাকেনা। প্রতিটি সাপের বিষ উদ্ধারের সময় সেখান থেকে ম্যানুয়ালও উদ্ধার হয়। তার মানে, প্রতারকরা এগুলো বিষয়ে এক্সপার্ট। এ কারণে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েই অনেকেই সর্বস্ব হারান বা সেটি দিয়ে তিনিও আবার প্রতারণা করেন। এভাবে এক প্রতারকের হাত বদলে অন্য প্রতারকের হাতে যায়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, এগুলো প্রতারকচক্রের কাজ। সাপের বিষ হোক আর ইউরেনিয়াম হোক কোনোটাই এখন পর্যন্ত সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। তার মানে এগুলো প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি বলেন, আমাদের নজরদারি থাকে বলে মাঝে মধ্যে উদ্ধার হয়। তবে এসব প্রতারকদের থেকে সাবধানতা অবলম্বন করাটাই ভালো। সবমিলিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর এ ধরনের কেউ যদি কাউকে অফার করে তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর অনুরোধ করেন গোয়েন্দা বিভাগের এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads