• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যয় বাড়ায় সঞ্চয় কমেছে দেশের অধিকাংশ মানুষের

প্রতীকী ছবি

অর্থনীতি

বাড়ছে ভোগ ব্যয়, কমছে সঞ্চয়

  • জাহিদুল ইসলাম ও নাজমুল হোসাইন
  • প্রকাশিত ০৯ এপ্রিল ২০১৮

২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৮ হাজার ৩৩২ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে সেটাই দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮৬২ টাকায়। এ দাবি সরকারের। যার অর্থ আট বছরে মাথাপিছু আয় আড়াই গুণ বেড়েছে। একই সময়ে দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৭৮ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসছে মানুষের জীবনমানে। খাদ্য, আবাসন, চিকিৎসা, পরিধেয় বস্ত্রসহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় বাড়তি টাকা খরচ করছে দেশের মানুষ। এতে করে বেড়ে চলেছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ভোগ ব্যয়। ফলে দেশের বাজারের বিস্তৃতি ঘটছে দ্রুত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একাধিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা উন্নীত হবে ২৪ লাখ ১৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকায়, আগের অর্থবছরে যা ছিল ২০ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই বৃদ্ধির হার ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ৩ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৯ কোটি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশটিই আসছে ভোগ ব্যয় থেকে। এ খাতেই খরচ হচ্ছে চাহিদার প্রায় ৭১ শতাংশ অর্থ।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আর অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়লে নতুন পণ্য উৎপাদন ও সেবা বিপণনে বিনিয়োগের পরিমাণও বেড়ে যায়। তবে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাড়তি ব্যয়ের কতটুকু আয় বৃদ্ধির কারণে আর কতটুকু পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে তা বিবেচনায় নিতে হবে। তার মতে, সমাজের কিছু মানুষ ব্যাপক আয় বৃদ্ধির কারণে বিলাসী জীবনযাপন করছে। তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ঋণ করছে তুলনামূলক কম আয়ের মানুষ। অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আরো নজর দিতে হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। 

credit_cards-1-1

চলতি অর্থবছর শেষে দেশে ভোগ বাবদ ব্যয় ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯২৯ কোটি টাকায় উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। আর সরকারি খাতে খরচ হবে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। গত অর্থবছর ভোগ বাবদ ব্যয় ছিল ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এক বছরে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর আগের বছরের তুলনায় ভোগ বাবদ ব্যয় বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর এ বাবদ ব্যয় বেড়েছিল ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ।

বাড়তি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে চাপ পড়ছে সঞ্চয়ে। চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের বিপরীতে জাতীয় সঞ্চয়ের হার নেমে আসবে ২৮ দশমিক ০৭ শতাংশে। গত অর্থবছর এ হার ছিল জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ হিসাবে চলতি অর্থবছর জাতীয় সঞ্চয়ের হার আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসছে। আর অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার নেমে আসছে জিডিপির ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশে। 

চলতি অর্থবছর অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৪৬০ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে সঞ্চয় বেড়েছে মাত্র ২৮ হাজার ১১০ কোটি টাকা। ১৫ দশমিক ৯০ ভাগ ভোগব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে সঞ্চয় বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছর সঞ্চয় বেড়েছিল ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ বৃদ্ধির হার ছিল ২৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ব্যয় জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে দেশে খানাপ্রতি মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০০৫ সালে পরিবারপ্রতি মাসিক আয় ছিল ৭ হাজার ২০৩ টাকা। একই সময়ে পরিবারপ্রতি মাসিক ব্যয় ৬ হাজার ১৩৪ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ফলে পরিবারপ্রতি সঞ্চয় ১ হাজার ৬৯ টাকা থেকে নেমে এসেছে ২৩০ টাকায়।

দেশের মানুষের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও কমে আসছে। খাদ্য ও পানীয় খাতে ব্যয় কমার বিপরীতে ব্যয় বাড়ছে বিলাসী পণ্যে। ২০১০ সালে দেশে মোট ভোগ ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়েছে খাদ্য খাতে। বর্তমানে এর হার নেমেছে ৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশে। পোশাক বাবদ ব্যয় ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১২ শতাংশে। আবাসন ও বাড়িভাড়া বাবদ খরচ ৯ দশমিক ৯৩ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশে। এ সময়ে চিকিৎসা খরচও ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

বিলাসী জীবনযাপনের কারণে ঋণ গ্রহণের প্রবণতাও বাড়ছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে প্রতিটি পরিবার গড়ে ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকা করে ঋণ নিয়েছে। ২০১০ সালে এ ঋণ ছিল ৩১ হাজার ৩৩২ টাকা।

মূলত শিল্প ও বাণিজ্যে অর্থায়নের লক্ষ্যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলেও এ খাতের ঋণের বড় অংশই ভোগ ব্যয়ে চলে যাচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে মোট ঋণের ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ খরচ হয়েছে শিক্ষায়। এ ছাড়া কৃষিতে ১৮ দশমিক ৩০ ও শিল্প খাতে ২২ দশমিক ১৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। আর অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়েছে মোট ঋণের ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে, ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ খাদ্যে, ১৭ দশমিক ০৯ শতাংশ আবাসনে, ৪ দশমিক ২০ শতাংশ বিবাহ খাতে গেছে। ব্যয়ের খাত চিহ্নিত হয়নি ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ ঋণের।

ভোগ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আর্থসামাজিক বেশকিছু সূচকে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। সংস্থার মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ইন বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থূল জন্মহার, মৃত্যুহার, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুর অনুপাত, জন্মনিয়ন্ত্রয়ণ পদ্ধতি ব্যবহার, আয়ুষ্কাল সূচকে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নতি করেছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ৭ মাসে উন্নীত হয়েছে। ৯৮ শতাংশ শিশুই প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশ করছে। দেশের ৮১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ আলোর উৎস হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। অথচ ২০০৫ সালে এ হার ছিল সাড়ে ৪৩ শতাংশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads