• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু নতুন অর্থবছর

২০১৮-১৯ অর্থবছর শুরু

প্রতীকী ছবি

অর্থ ও বাণিজ্য

বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু নতুন অর্থবছর

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০১ জুলাই ২০১৮

মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার বিশাল লক্ষ্য নিয়ে আজ রোববার শুরু হচ্ছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর। একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশাল এই লক্ষ্য অর্জনে বিনিয়োগের পরিমাণ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ১ দশমিক ৯০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। লক্ষ্য পূরণে নতুন অর্থবছরে বাড়তি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ আহরণ করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের বছরে বিশাল এই লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অতীতে বাংলাদেশের সব নির্বাচনের বছরেই বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধিও হয়েছে আগের বছরগুলোর চেয়ে কম। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন তারা। চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড়, এলসি সুবিধাসহ বেশ কিছু সুবিধা প্রত্যাহার করায় পণ্যটির দাম বাড়বে। আর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে এর প্রভাবে বাড়বে অন্যান্য পণ্যের দাম। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য পূরণও কঠিন হয়ে দেখা দিতে পারে।

অবশ্য নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটের মানসম্মত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাজেট বাস্তবায়নে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা আয়ের প্রায় অসম্ভব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দক্ষতার অভাবে প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের লক্ষ্য অপূর্ণ থাকছে। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি না থাকায় মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। সুশাসনের অভাবে ব্যাংক খাতেও বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা। এ অবস্থায় আগামীতে অর্থনীতির গতি ধরে রাখা সহজ হবে না বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রাথমিক হিসাবে প্রবৃদ্ধির হার বেশি। এ ধারাবাহিকতা রক্ষায় নতুন অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

অতীতের প্রতিটি নির্বাচনের বছরেই বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর আগের পাঁচ বছর ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ০২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ হিসাবে নির্বাচনের কারণে ২০০৮-০৯ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ছিল আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বছরখানেক আগেই শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন। এর ফলে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ৬ দশমিক ০১ শতাংশে। পরের অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। এর পরের বছর থেকেই প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে।

২০১১-১২ অর্থবছর বেসরকারি খাতে জিডিপির ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ হলেও তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনে পরের অর্থবছর তা নেমে আসে ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ২২ দশমিক ০৩ শতাংশ বিনিয়োগ হলেও পরের বছরগুলোতে তা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেটে ১ লাখ ২৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা ঘাটতি আহরণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার কারণে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে আসবে। এর ফলে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। তা ছাড়া নির্বাচনের বছর উদ্যোক্তাদের আস্থার অভাবের কারণে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে আসে। বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণ হলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, বেসরকারি খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ বছরে বাড়ছে ৯ শতাংশ। সম্প্রতি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) বেশ কিছু প্রস্তাব পাওয়া গেছে, তা ছাড়া ব্যক্তি খাতে বিদেশি ঋণও আসছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক শতাংশ বাড়লে ব্যক্তি বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণ হবে। তবে এজন্য জোরদার প্রচেষ্টা চালাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

নতুন অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৫৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে জিডিপির ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ হবে বলে প্রাথমিক হিসাব করে জানিয়েছে বিবিএস। এ হিসাবে এক বছরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে ২ দশমিক ০৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো বছর এত বেশি বিনিয়োগ বাড়েনি বলে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। বিবিএস জানিয়েছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছর বিনিয়োগ হয়েছিল জিডিপির ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ অর্থ। এ হিসাবে ১৬ বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সম্প্রতি বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা ও তারল্য সঙ্কটের কারণে আগামীতে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। অবকাঠামো খাতে উন্নতির কাজ চলমান থাকলেও বড় প্রকল্প শেষ হচ্ছে না। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন বছরে অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাজেটের গুণগত বাস্তবায়ন। বাজেটে বেঁধে দেওয়া আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণের সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া ব্যাংক খাতে সংস্থার, এডিপির গুণগত বাস্তবায়নের নিশ্চয়তাও নেই। প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে এসব বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে বলেও জানান তিনি।

দারিদ্র্য নিরসনে ধীরগতি ও আয় বৈষম্য আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁঁড়াবে বলে মনে করেন বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, গড় বাৎসরিক দারিদ্র্য নিরসনের হার ২০০৫-১০ সময়ের ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০১০-১৬ সময়ে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আয় বৈষম্যের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগে বৈষম্য, বহুমাত্রিক দরিদ্রতা ও বেকারত্ব বিশেষ করে যুব বেকারত্ব দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া সুদের হার বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগের ব্যয়ও বাড়বে। তিনি আরো বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে গুণগত মানসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে তিনি অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads