• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বিদেশি সাহায্যে বড় অংশীদার হচ্ছে রাশিয়া ও চীন

বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থ সাহায্যপ্রাপ্তিতে গত কয়েক বছরে রাশিয়া ও চীন বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে

ছবি : ইন্টারনেট

অর্থ ও বাণিজ্য

বিদেশি সাহায্যে বড় অংশীদার হচ্ছে রাশিয়া ও চীন

  • কাওসার আলম
  • প্রকাশিত ০২ জুলাই ২০১৮

ঋণ ও অনুদান হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিবছর যে পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ সাহায্য পেয়ে আসছে তার বড় অংশই আসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে। এসব সংস্থার বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকেও অর্থ সাহায্য নিয়ে থাকে বাংলাদেশ। অর্থ সাহায্যের দিক থেকে গত কয়েক বছর ধরেই একক দেশ হিসেবে শীর্ষস্থানে রয়েছে জাপান। বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থ সাহায্যপ্রাপ্তিতে দেশ হিসেবে জাপানের পাশাপাশি গত কয়েক বছরে রাশিয়া ও চীন বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে। অথচ কয়েক বছর আগেও এ দুটি দেশ থেকে কোনো ধরনের অর্থ সাহায্য পায়নি বাংলাদেশ।

সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ থেকে মোট ৩৪২ কোটি ৪ লাখ ডলার বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে ৫৪ কোটি ৪৮ লাখ ও চীন থেকে ৩৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলার পাওয়া গেছে। মোট বৈদেশিক সহায়তার ২৭ শতাংশেরও বেশি এসেছে এ দেশ দুটি থেকে। যদিও একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য এসেছে জাপান থেকে। জাপান থেকে পাওয়া গেছে ৯৭ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, যা মোট সাহায্যের ২৮.৬১ শতাংশ।

বাংলাদেশকে বৈদেশিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে রয়েছে বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। চলতি অর্থবছরে এ দুটি সংস্থা থেকে মোট বিদেশি সহায়তা পাওয়া গেছে ১১৯ কোটি ১৪ লাখ ডলার, যা মোট সহায়তার ৩৪.৮৩ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি ১১ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার অর্থ সাহায্য পাওয়া গেছে জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ থেকে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে ১২ লাখ, যুক্তরাজ্য ৩৩ লাখ ডলার সাহায্য দিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, সুইডেন, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া থেকে কোনো সহায়তা পায়নি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮ থেকে বৈদেশিক অর্থ সাহায্যের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ১৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থ সাহায্যপ্রাপ্তিতে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা বাড়ছে। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৩-১৪-এ দেশটি থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া গেছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার বৈদেশিক সাহায্য পায় রাশিয়া থেকে। পরবর্তী অর্থবছরে সাহায্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটি ২৭ লাখ ডলারে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাহায্যের পরিমাণ ৯ কোটি ২৪ লাখে নেমে এলেও বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৭-১৮) সাহায্য পাওয়া গেছে ৫৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এর মাধ্যমে বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে রাশিয়া।

অপরদিকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ কোটি ৭০ লাখ ৪০ হাজার ডলার সাহায্য পাওয়া যায় চীন থেকে। এর পরের অর্থবছরে (২০১৩-১৪) একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ ৪৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার অর্থ সাহায্য আসে দেশটি থেকে। পরবর্তী তিন অর্থবছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০১৬-১৭) সাহায্যের পরিমাণ কমলেও বিদায়ী অর্থবছরে চীন ৩৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলার অর্থ সাহায্য দিয়েছে, যা একক দেশ হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ।

অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরের আগের চার অর্থবছরে (২০০৮-০৯ থেকে ২০১১-১২) দেশটি থেকে এক টাকাও সাহায্য পাওয়া যায়নি। আর ২০০৫-০৬ থেকে ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত চীন থেকে সাহায্য পাওয়ার কোনো তথ্য নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বিদেশি সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সনাতনী যেসব দেশ রয়েছে সেখানে এখন নতুন অনেক দেশ যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার যে একটি নতুন ধারা তৈরি হয়েছে সেখানে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ নতুন কিছু দেশ সাহায্যদাতা দেশ হিসেবে আর্ভিভূত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো যেসব সংস্থা রয়েছে তারা সব ধরনের প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দেয় না। অথচ আমাদের রেল, বন্দর, যোগাযোগ খাত, এলএনজি টার্মিনালসহ আরো অনেক খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এসব খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন, রাশিয়া থেকে আমরা সাহায্য গ্রহণ করছি। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া গেলেও বিভিন্ন দেশ থেকে যে ঋণ নেওয়া হয় তার সুদের হারও বেশি ও স্বল্প মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে। গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যায় না। ফলে সুদে আসলে সময়মতো এসব ঋণ পরিশোধ করাটা সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ঋণ ও অনুদান হিসেবে বৈদেশিক অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে। তবে স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছর ঋণ ও অনুদান হিসেবে খাদ্য সহায়তা নিতে হতো বাংলাদেশকে। দেশে শিল্প উৎপাদন খুব বেশি না হওয়ায় নানা ধরনের পণ্য আনতে হতো বিদেশ থেকে। কিন্তু রফতানি আয় বেশি না হওয়ায় পণ্য আমদানিতে ঋণ ও অনুদান নিতে হতো। কিন্তু গত চার দশকে উৎপাদনের পাশাপাশি রফতানি আয় বাড়ার কারণে এখন খাদ্য সহায়তার জন্য ঋণ বা অনুদানের প্রয়োজন হচ্ছে না। এখন বৈদেশিক সাহায্যের বড় অংশই নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। শুরুতে প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ কম ছিল। এখন যতটা অনুদান আসে, তার দ্বিগুণ আসে ঋণ। উন্নয়নের জন্য প্রকল্প সহায়তা এখন বেশি নিচ্ছে বাংলাদেশ।

অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পর্যাপ্ত অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বিধায় এখনো বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্তিতে দাতাগোষ্ঠীর নানা ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্ত পূরণ করতে না পারার কারণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থছাড় দেয় না দাতাগোষ্ঠীরা। এ কারণে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিশ্রুতি থাকলেও ৪ হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তা পাইপলাইনে আটকে আছে।

প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় না হওয়ার কারণ হিসেবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে সম্পন্ন করতে না পারা, শর্ত পূরণে ব্যর্থতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবসহ নানা কারণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৈদেশিক সাহায্য ছাড় দিচ্ছে না দাতাগোষ্ঠীরা। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এখনো বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাহায্য পেতে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে সহজ শর্তে এখনো ঋণ সুবিধা পেয়ে আসছে। চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে প্রথম ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করে। ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ পাবে না বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তিতে বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। ইতোমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ স্বীকৃতির কারণে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ব্লেন্ডেড রেটে অর্থ সাহায্য নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

অবশ্য বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের পর বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না, এমনটিই মনে করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ২৪ জুন সিপিডি আয়োজিত বাজেট আলোচনায় তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশকে বিদেশি উৎস থেকে অর্থ ধার করতে হচ্ছে কিন্তু ২০৩০ সালের পর থেকে আমাদেরকে আর বাইরে থেকে অর্থ ধার করতে হবে না। চীন আমাদের ঋণ দিচ্ছে, অথচ ওদের ঋণের পরিমাণ জিডিপির তুলনায় ১৮৫ শতাংশ। ১০০ শতাংশের নিচে কোনো দেশে নেই। আমার লেখাপড়া যদি সত্য হয়, তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা আশপাশের দেশকে ঋণ দেব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads