• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সংকটের ধাক্কা মুনাফায়

ছবি : সংগৃহীত

অর্থ ও বাণিজ্য

সংকটের ধাক্কা মুনাফায়

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ০২ জুলাই ২০১৯

শেয়ারবাজারের জন্য মূল্য সংবেদনশীল বিবেচনায় তালিকাভুক্ত ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা প্রকাশের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ব্যাংকগুলো বিএসইসির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য দেওয়ার পর স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে এ তথ্য দিতে বেশ সময় লেগে যায়। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার আগের তুলনায় কম। অর্থাৎ সংকট ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা খেয়ে ফেলেছে।

ব্যাংক খাতে নগদ টাকার টানাটানি গেছে। তারল্য সংকট থেকে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঋণ দিতে পারেনি ঠিকমতো। টাকার পাশাপাশি ডলারের সংকট ব্যাপকভাবে সামনে এসেছে। সংকট থেকে বেড়ে যায় সব ধরনের ঋণ ও আমানতের সুদহার। আমানতকারীকে কোনো কোনো ব্যাংক ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতে শুরু করে টাকার টানাটানি দূর করতে। আবার আমানতের উচ্চ সুদের হারের কারণে বিনিয়োগের সুদহার ১৭-১৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক মালিকরা প্রতিশ্রুতি দিলেও কমেনি সুদহার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সেটিও আমলে নেওয়া হয়নি। 

অথচ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের নীতি সহায়তা নিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কাটাতে নতুন নিয়মে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ পাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক। কমানো হয়েছে নগদ জমার হার (সিআরআর)। সব তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের সাড়ে ৬ শতাংশ হারে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এবং ৬ শতাংশ দৈনিক হারে নগদ জমা সংরক্ষণ করার বিধান ছিল। সেটি পুনর্নির্ধারণ করা হয় সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং দৈনিক ভিত্তিতে ৫ শতাংশ। আগ্রাসী ব্যাংকিং করে তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত হার নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে গত মার্চ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। সেটিও বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর করা হয়েছে।  

জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে ব্যবসা করছে। সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতি। অনেক ব্যাংক তার মূলধনও খেয়ে ফেলেছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও উন্নতি নেই। ফলে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাংকিং খাতের জন্য কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি থাকলেও অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল এ ব্যাপারে এখনো স্পষ্ট কিছু বলেননি।  

চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) তারল্যের টানাটানির কারণে আশানুরূপ ঋণ বিতরণ করতে পারেনি অনেক ব্যাংক। শেয়ারবাজার থেকেও অনেক ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। তবে আমদানি ও রপ্তানির এলসি থেকে ভালো কমিশন আয় হয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংকের। ব্যাংকগুলোর প্রায় নয় লাখ কোটি টাকার ঋণ স্থিতি থেকে আয় অব্যাহত রয়েছে।

পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ এবং করপোরেট কর পরিশোধের পর ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফার হিসাব হয়। নিট মুনাফার ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। ফলে এসব ব্যাংকের মুনাফা নিয়ে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ বেশি থাকে। নিট মুনাফার হিসাব এখনো না পাওয়া গেলেও করপোরেট কর কমে যাওয়ায় এবার ব্যাংকগুলোর আগের চেয়ে কম কর পরিশোধ করা লাগবে। যা মুনাফার জন্য ইতিবাচক।

ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস ঋণের বিপরীতে সুদ এবং বিভিন্ন কমিশন ও চার্জ। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকেও আয়ের একটি অংশ আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আমদানিতে ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর মে পর্যন্ত রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আমদানি ও রপ্তানির বাইরেও বিভিন্ন কমিশন ও চার্জ থেকে ব্যাংকগুলোর আয় এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণ থেকে প্রতি মাসেই আয়ের বড় একটি অংশ পাচ্ছে ব্যাংক। সবমিলিয়ে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। অবশ্য ব্যাংক খাতে ১০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ না থাকলে মুনাফা আরো ভালো হতো বলে ব্যাংকাররা মনে করেন। আর এ জন্য খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য জানা গেছে, বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রথম ৬ মাসে পরিচালনা মুনাফা করেছে ২৯৫ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৭৫ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০১৮ সালের জানুয়ারি-জুনে ছিল ২৬০ কোটি টাকা। আর এ বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৫ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৩৩১ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩২৫ কোটি টাকা। নতুন প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফা ৫০৫ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৪৫৪ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কর্মাস ব্যাংকের পরিচালনা মুনাফা হয়েছে ৩৬২ কোটি টাকা। আগের বছরের প্রথম ৬ মাসে ছিল ২৯৭ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা মুনাফা গত বছরের ৩২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩০ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রথম ৬ মাসে মুনাফা হয় ১২৮ কোটি টাকা। কিন্তু তা অস্বাভাবিক বেড়ে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ২২৭ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংকের পরিচালনা মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৫ কোটি টাকা। মধুমতি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৯০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৮ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংকের পরিচালনা মুনাফা হয়েছে ৩১১ কোটি টাকা। এটি আগের বছরে একই সময়ে ছিল ২৬৭ কোটি টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৭৩ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ২২৯ কোটি টাকা। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক বছরের প্রথম ৬ মাসে মুনাফা করেছে ৫১০ কোটি টাকা। এটি ২০১৮ সালের একই সময় ছিল ৪১৮ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড পরিচালন মুনাফা করেছে এক হাজার ২২৩ কোটি টাকা। আগের বছর এই সময় যার পরিমাণ ছিল এক হাজার ২১ কোটি টাকা। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৩২০ কোটি টাকা। আগের বছর একই সময় ছিল ২১১ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে। আগের বছর প্রথম ৬ মাসে মুনাফা করে ৩৩৭ কোটি। সেটি কমে হয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৫৪০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। আগের বছর একই সময় ছিল ৪৫৭ কোটি টাকা। এনআরবিসি ব্যাংকের এ বছর মুনাফা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৭৭ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়ে হয়েছে ২৬৪ কোটি টাকা। আগের বছর একই সময় ছিল ২১০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads