• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
জবাবদিহিতে সংস্কারমুখী আর্থিক খাত

ছবি : সংগৃহীত

অর্থ ও বাণিজ্য

জবাবদিহিতে সংস্কারমুখী আর্থিক খাত

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২৪ আগস্ট ২০১৯

আর্থিক খাত আবার সংস্কারমুখী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে আর্থিক খাত সংস্কারের বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়। দলটি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আট মাস পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সরকার ঘোষিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রী করা হয় আ হ ম মুস্তফা কামালকে। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর এ পর্যন্ত আর্থিক খাতের সংস্কার ও জবাবদিহির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখাতে পারেননি তিনি। তবে এবার তার শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি। তিনি নতুন মন্ত্রী হিসেবে ধীরে চলো নীতিতে ছিলেন। আমলাতন্ত্র ও আর্থিক খাত পর্যালোচনায় সময় নিয়েছেন। এখন তিনি আস্তে আস্তে তার পদক্ষেপ ও চিন্তা দৃশ্যমান করতে শুরু করবেন। তবে সবার আশা, পদক্ষেপ যাতে প্রকৃত অর্থে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে হয়। অর্থনীতিকে বিপদমুখী করবে-এমন কোনো সিদ্ধান্ত যাতে না আসে। তবে আর্থিক খাত যেকোনো সময়ের তুলনায় সংকটে।

জানা গেছে, গত কয়েক দিনে ব্যাংক খাতে বেশ কিছু রদবদল হয়েছে। এর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ওবায়েদউল্লাহ আল মাসুদকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রূপালী ব্যাংকের। আর রূপালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধানকে নিয়োগ দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি প্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থান ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বাংলাদেশ-আইসিবির এমডি অদল-বদল করছে সরকার। আইসিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হককে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর কর্মসংস্থান ব্যাংকের এমডি আবুল হোসেনকে আইসিবি’র এমডি করা হয়েছে।

এদিকে নতুন চেয়ারম্যান পাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ পাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। আর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদকে। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে জনতা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহাকে। দুই ব্যাংকের নতুন দুই চেয়ারম্যানকে নিয়োগ দেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকে। এর আগে জনতা ব্যাংকে দুজন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগে দীর্ঘদিনের রাজনীতিকীকরণের অভিযোগ তুলতে পারেননি বিশ্লেষকরা।

অর্থমন্ত্রী নিয়মিতভাবে বৈঠক করছেন আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। দিচ্ছেন নির্দেশনা। সম্প্রতি তিনি বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে বৈঠক করেন। এর আগে কয়েক দফা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে নিয়মিত বৈঠক চলছে তার।

সূত্র বলছে, আগামীকাল রোববার আবারো সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে বৈঠক করবেন তিনি। একই দিনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

ব্যাংক পরিচালকদের সহায়তায় অসাধু ব্যবসায়ীরা যোগসাজশে অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঋণগুলো খেলাপি হয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সর্বশেষ হিসাবমতে, জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। কিছু ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আইনের আওতায় এলেও বড় অনিয়ম এবং জালিয়াতিতে প্রত্যক্ষ মদদ থাকলেও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো শক্ত পদক্ষেপ সামনে আসেনি। অথচ পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পারেন না কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি করতেও। কিন্তু সেই পর্ষদ সদস্যরা সব সময় থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক সময় পুরস্কৃত হচ্ছেন। কিন্তু সেটি আর থাকছে না। পরিচালকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চায় সরকার।

বর্তমানে দেশে সরকারি ব্যাংকের সংখ্যা আটটি। এর মধ্যে ছয়টি বাণিজ্যিক ও দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক। এসব ব্যাংকে প্রায় একশ পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংকগুলো মিলিয়ে দেশে ব্যাংকের পরিচালক সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭শ। তবে অনেক পরিচালকই ব্যাংকিং কার্যক্রমের খুঁটিনাটি ভালোভাবে জানেন না। ফলে অনিয়ম ও জালিয়াতি এবং ব্যাংকিংয়ের সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পর্কে তারা তেমন সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। কেবল পরিচালনা পর্ষদের নিয়মিত বৈঠকে তারা অংশ নিয়ে সম্মানী নিয়ে আসছেন। এর বাইরে অনেক পরিচালকের বিরুদ্ধে তদবিরসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, পরিচালকদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা আছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। সেখানে তাদের দায়দায়িত্ব স্পষ্ট করা আছে। এর সঙ্গে সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৩ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারিও করা হয়। তবে বেশিরভাগ পরিচালক সেটি আমলে নেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে পরিচালকরা অনেক কিছু জানতে পারবেন।

নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের নীতি-নির্দেশনা প্রণয়ন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান সুচারুরূপে সম্পন্নকরণে তথা ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ও পেশাগতভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব অপরাপর কোম্পানির তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড প্রধানত আমানতকারীদের অর্থে পরিচালিত হয় এবং ক্ষেত্রে আমানতকারীদের আস্থা অর্জন করা ও বজায় রাখা অপরিহার্য। সুশাসনের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে পরিচালনা পর্ষদের গঠন, দায়-দায়িত্ব ও তদ্সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নজর দিতে হবে।

আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপ সম্পাদন কিংবা জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারার আওতায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক ব্যতিরেকে যেকোনো ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যানকে বাংলাদেশ ব্যাংক অপসারণ ও ৪৭ ধারার আওতায় যেকোনো ব্যাংক-কোম্পানির পর্ষদ বাতিল করতে পারে।

দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করবে। লক্ষ্য অর্জনের কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা বার্ষিক ভিত্তিতে প্রণয়ন করবে। নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কৌশল প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সাংগঠনিক পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাস এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য নীতিগত বিষয়ে পর্ষদ বিশেষভাবে নিয়োজিত থাকবে। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্ষদ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরিবীক্ষণ করবে।

আলাপকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাত একটি দুষ্টচক্রের কব্জায়। এখানে সুশাসন আনতে চাইলে পর্ষদে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তবে কেবল সচেতন করে হবে না। কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ দেখাতে হবে। তবেই সুশাসন আসবে।

জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন চলতি অর্থবছরের জন্য। সেখানে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্জন করতে চান যেকোনোভাবে। সে ব্যাপারে আগামীকাল রোববার এনবিআর কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বলেন, আর্থিক খাতের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারবেন শিগগিরই। কাজ শুরু হয়ে গেছে। সবাই আমাকে সহায়তা করুন। আমি ভালো কিছু করতে চাই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads