• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
জুমের পাশাপাশি বাড়ছে ফলবাগান

ফাইল ছবি

অর্থ ও বাণিজ্য

পাহাড়ের কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা

জুমের পাশাপাশি বাড়ছে ফলবাগান

  • প্রকাশিত ০৬ নভেম্বর ২০১৯

পাহাড়ে একসময় কৃষি বলতে ছিল জুম চাষ। সারা বছরের খাদ্যের জোগান হতো জুম থেকে। জুমচাষিরা বিশেষ কায়দায় পাহাড়ে চাষ করতেন। কিছু গাছ কাটা পড়ত বটে, তবে বড় গাছে করাত পড়ত না। জুম ছেড়ে এখন ফলদ বাগানে ঝোঁক তাদের। জুমের পাশাপাশি এখন চাষিদের কাজুবাদাম, কফি ও মাল্টা চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানায় বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ে জুম চাষ কমছে। কৃষকদের অনেকেরই চাষাবাদ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রয়েছে। তাই জুম পাহাড়ের ক্ষতির কারণ নয়; বরং পাহাড়িরা জুম চাষ ছেড়ে দেওয়ায় পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানালেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জুম। জুম চাষ করে জীবনযাপন করেন, তাই এদেরকে জুমিয়া বলা হয়। যুগ যুগ ধরে আদি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় জ্বালানি তেল, লবণ আর সাবান ছাড়া জুমেরা ফসল দিয়েই জীবনযাপন চলে পাহাড়িদের।

এক দশক আগেও এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর ১০-১৫ বছর ওই পাহাড়ে আর কোনো চাষ হতো না। পাহাড়কে দেওয়া হতো প্রাকৃতিক বনাঞ্চল গড়ে ওঠার সুযোগ, উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মাটি পেত অনেক সময়। কিন্তু জুম চাষের জমি সংকুচিত হওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে জুমিয়ারা একই পাহাড়ে ঘন ঘন জুম চাষ করছে। আবার অর্থকরী ফসল হিসেবে জুমে বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি হলুদ, আদা, মুখি কচুর আবাদ বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে কমছে জমির উর্বরতা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বিকাশ, বৃদ্ধি পাচ্ছে পাহাড়ের ভূমি ক্ষয়, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রাণিজ সম্পদ।

জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাচীনতম পেশা হিসেবে বিবেচিত হয় জুম চাষ। তাই তাদের জুমিয়া বলা হয়। ধানি জমির অভাবে পার্বত্য আদিবাসীদের প্রায় সব সম্প্রদায়ের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল পাহাড়ের উপযোগী জুম চাষ। জুমের ফসল তোলায় ব্যস্ত পাহাড়ের মানুষ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায়  গেল বছরের চেয়ে ফলন হয়েছে ভালো। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবার রাঙামাটিতে ৫ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে জুমের ধান আবাদ হয়েছে। আর বান্দরবানের সাত উপজেলায় জুম চাষ হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৫ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে। পাহাড়ে জুম ক্ষেতে এখন পাকা ফসল তোলার ভর মৌসুম। এ মৌসুমে উপযুক্ত জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের কারণে এবং ইঁদুরের উৎপাত কমে যাওয়ায় ভালো ফলন হয়েছে। কোনো সমস্যা ছাড়াই জুমের সোনালি ফসল ঘরে তুলতে পারায় জুম্ম নারী-পুরুষ ফিরে পেয়েছে মুখের হাসি। জুমিয়াদের ঘরে ঘরে জুমের সোনালি ফসল তোলার আনন্দ। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষের জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস এ জুম চাষ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগই জুম চাষনির্ভর। তথ্যানুসন্ধানে জানাগেছে, ১৮১৮ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষই একমাত্র কৃষি চাষ পদ্ধতি ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে তিন পার্বত্য জেলা ৫ হাজার ৪৮০ বর্গকিলোমিটার অশ্রেণীভুক্ত বনভূমির সিংহভাগেই জুম চাষ করা হয়। তিন জেলার কমবেশি ৪৩ হাজার পরিবার জুম চাষনির্ভর। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির প্রায় ২২ হাজার, রাঙামাটির প্রায় ১০ হাজার ও বান্দরবানে প্রায় ১৩ হাজার জুমিয়া পরিবার আছে। বাংলাদেশের একমাত্র তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এ জুম চাষ করা হয়। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে নবান্ন উৎসব। তিন জেলার প্রায় ২৫ হাজার ৪শ’ হেক্টর পাহাড় ভূমিতে জুম চাষ হয়েছে এবার। ধুম পড়েছে মারফা, বেগুন, ধানি মরিচ, ঢ্যাঁড়শ, কাঁকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল তোলার কাজ। এরপর ঘরে উঠবে তিল, যব এবং সব শেষে তোলা হবে তুলা।

পাকা ধানে ভরপুর : ব্যস্ত জুমিয়ারা

পাহাড় এখন জুমের পাকা ধানে ভরপুর। তাই এ পাকা ধান বাড়িতে তোলা নিয়ে ব্যস্ত জুমিয়ারা। জুম হলো পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে ফসল ফলানো। সমতল ভূমিতে যেমন প্রতি বছর ফসল ফলানো যায়, জুমে কিন্তু একই পাহাড়ে প্রতি বছর ফসল ফলানো যায় না। একবার জুম চাষ করার পর ওই পাহাড়টি ৪-৫ বছর পতিত রাখার পর আবার একই পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়। কৃষিবিজ্ঞানীরা জুম চাষকে বলেন স্থানান্তরিত কৃষি এবং কেউ কেউ পর্যায়ক্রমিক চাষও বলে থাকেন। চাষ পদ্ধতি এক হলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে জুম চাষ আলাদা নামে পরিচিত। জুম চাষকে চাকমা ভাষায় জুম, মারমা ভাষায় ইয়াঁ, ত্রিপুরা ভাষায় হুগ, ম্রো ভাষায় উঃঅ, খিয়াং ভাষায় লাই, বম ভাষায় লাও বলা হয়। পাহাড় বাছাই থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত জুমচাষিরা কয়েকটি ধাপে এ কাজ সম্পন্ন করে। এ ধাপগুলো হলো- দুজ মারা, জুম ফাঙ গরানা, জঙ্গল কাটা, জুম পোড়ানা, আরা কাজানা, মোনঘর তৈরি, আনুনী কাটা, বী খের সুরো, বীজ বপন, দুজ মারা, মধ্যসুলো ও মেইড সুলো, পেগরাগানা, ধান কাটা ফাঙ ও নোভাত খাওয়া, অন্যান্য ফসল তোলা। জুমের ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নানাজাতের ধান, কুমড়া, অড়হড়, শিম, শসা, করলা, ঢ্যাঁড়শ, তিল, ভুট্টা, আদা, যব, তুলা, হলুদ, পাহাড়ি আলু, কচু ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে, পাহাড়িরা প্রকৃতির সন্তান। জুম চাষও সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। জুমিয়ারা চাষে কোনো লাঙল অথবা কোদাল ব্যবহার করে না। বীজ বপনের পর কোনোরকম রাসায়নিক সার, কীটনাশক অথবা আধুনিক কোনো সেচও ব্যবহার করা হয় না। আর তাই জুমে উৎপাদিত সবজি, ফলমূল হয় খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জুমের ফসল কাটার মৌসুম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চাষ হচ্ছে জুম চাষ। জুমিয়ারা পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতির এই আদি জুম চাষ করে থাকে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুম প্রস্তুত করার জন্য গাছপালা কাটা হয়। মার্চ-এপ্রিলের দিকে শুকনা গাছপালা আগুনে পুড়িয়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ বপন করা হয়।  সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ  থেকে শুরু হয় ফসল  তোলা। জুম্ম নারীরা ব্যস্ত জুমের পাকা ধান কাটতে।

ক্রিক পদ্ধতিতে চলছে কৃষি

ক্রিক অর্থ হলো দুই অথবা তিন পাহাড়ের সঙ্গে বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করা।  পার্বত্য চট্টগ্রামে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে পাহাড়ের পতিত জমিতে ক্রিকের মাধ্যমে মাছ চাষসহ অন্যান্য চাষাবাদে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিয়ে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২৫ উপজেলায় দুই পাহাড়ের মাঝে ক্রিকের (ঘোনায় মাছ চাষের জন্য বাঁধ) মাধ্যমে অর্থাৎ পাহাড়ি ঘোনায় মৎস্য চাষের এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ৯৫টি ক্রিক নির্মাণ করা হয়েছে। আরো তিন শতাধিক ক্রিক নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সব ক্রিক নির্মাণ শেষ হলে শিগগিরই পার্বত্য এলাকায় মাছচাষের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সবাই। ক্রিক পদ্ধতির সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাছ চাষ করা। তাছাড়া ক্রিকের পানি দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করা, খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। আর যে বাঁধটা দেওয়া হয়, তার সুবিধা নিয়ে শাক-সবজি চাষ করা, বাঁধের ওপর যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করা। মৎস্য বিভাগ পাহাড়ের মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে। এ কাজের মাধ্যমে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুফলভোগীরা মাছ চাষের পাশাপাশি হাস-মুরগি পালন, শাক-সবজির চাষ করে অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেতে শুরু করেছে। এখন জুমচাষের পাশাপাশি নতুন ক্রিক পদ্ধতিতে চলছে পাহড়ের কৃষি। পার্বত্য এলাকার এই ক্রিকের প্রকল্প এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ড্রাগন ফলের চাষ

জুম চাষে ফলন কম হওয়ায় পাহাড়িরা আম ও আনারসসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল চাষ করছেন। ফলে পার্বত্য এলাকায় বেড়েছে ফল উৎপাদন। পাহাড়ে বাড়ছে বিদেশি ফল ড্রাগনের চাষ। স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় বান্দরবানে জুম চাষ ছেড়ে ড্রাগন ফল চাষে ঝুঁকছেন পাহাড়িরা। চিম্বুক পাহাড়ের বসন্ত পাড়ায় বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ করে লাভবান হয়েছেন অনেকে। বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, বিদেশি ফল হলেও পাহাড়ের জলবায়ু এবং মাটি দুটিই ড্রাগন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পাহাড়ে ড্রাগন ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ কম এবং পানির সেচ কম লাগায় এ চাষে আগ্রহী হচ্ছে পাহাড়িরা। আম্রপালি জাতের বাগান স্থাপনে পাহাড়ি এলাকায় এক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হওয়া ও মাটিতে রসের অভাবের কারণে এ আমের মিষ্টতা বেশি, যা অন্য জেলাতেও যথেষ্ট সমাদৃত। বাগানি আমের ভালো দাম পাচ্ছে, আবাদে আরো উৎসাহিত হচ্ছে। এখানে সীমিত আকারে রাঙ্গুয়াই নামক আমের বারমিজ জাতটির সম্প্রসারণ হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর মাল্টা-কমলা, বাতাবি ও অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলের আবাদ দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়িদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস কলা চাষ। আগে অনেকটা নিম্নমানের চাঁপাকলা কম যত্নে আবাদ করা হতো। এখন দৃশ্য অনেকটা পাল্টাচ্ছে। বাংলাকলা আবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে।  তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোকজন নির্ভরশীল কলা চাষের ওপর। পাহাড়ি এলাকায় লম্বা জাতের বহু বছরজীবী এক জাতের পেঁপে চাষ প্রচলন আছে। মূলত বসতবাড়ি ও জুমের ফাঁকে সীমিত আকারে এ ফলের চাষ চলছে। জুম চাষ তাদের জীবিকার আদিম পেশা হলেও তা আবাদ হয়ে থাকে বছরে কেবল এক মৌসুমে। কিন্তু কলা চাষ করে ফলন পাওয়া যায় বছরজুড়ে সব মৌসুমে। পার্বত্য জেলার অনেক বাগানের আধা ছায়া যুক্ত স্থানে লটকন চাষের প্রচুর সুযোগ আছে বিধায় ১৫-২০ ফুট দূরত্বে এ ফল বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে অধিক আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। রাঙামাটি কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, আগে জুম চাষে প্রচুর ফলন পাওয়া গেলেও দিন দিন ফলন কমছে। এর ফলে পাহাড়িরা ফলের বাগান চাষে ঝুঁকছে। একইসঙ্গে বেড়েছে আদা ও হলুদ  চাষ। এতে কৃষক লাভবানও হচ্ছে।

স্ট্রবেরি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা

পাহাড়ে টসটসে, রসালো, মিষ্টি ফল স্ট্রবেরি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তামাক চাষ থেকে চাষিদের ফিরিয়ে আনতে পাহাড়ের মাটিতে স্ট্রবেরি চাষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সহযোগিতায় উদ্যোগী হচ্ছে জেলা পুলিশ বিভাগ। রাঙামাটি সুখী নীলগঞ্জ এলাকায় পুলিশ বিভাগের বাগানের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধিসহ বিভিন্ন গাছের বাগান। এসব মিশ্র ফলের গাছের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে স্ট্রবেরি চাষ। উৎপাদিত স্ট্রবেরি দেখে আকৃষ্ট হচ্ছে স্থানীয় চাষিরা। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সূত্রে জানা যায়, সাধারণত যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও বেশিদিন শীত থাকে সেসব এলাকায় স্ট্রবেরি চাষ করা যেতে পারে। যেমন, পঞ্চগড়, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, এমনকি পাবনা, নাটোরেও স্ট্রবেরি চাষ করা হয়। তবে দেশীয় আবহাওয়া, মাটি ও পরিবেশের ভারসাম্যকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ের মাটিতে সঠিকভাবে চাষাবাদের মাধ্যমে স্ট্রবেরির উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। এতে করে স্থানীয় চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।

কাজুবাদাম চাষে নতুন আশা

শুধু বাদাম হিসেবেই নয়, কাজু ফলের (কাজু আপেল) খোসারও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উৎকৃষ্ট মানের জৈব বালাইনাশক তৈরি করা সম্ভব, যা নিরাপদ ফসল ও খাদ্যোৎপাদনে অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে কাজু আপেলের জুসও বেশ জনপ্রিয়। ফলের রস সংগ্রহের পর অবশিষ্ট মণ্ড বা ছোবড়া দিয়ে জৈব সার উৎপাদন করা যায়। ফলে সবদিক থেকেই কাজুবাদাম একটি লাভজনক কৃষিপণ্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বান্দরবানের ৪ দশমিক ৮ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে কাজুবাদাম উৎপাদন হবে। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন ৭০০ কৃষক। সবচেয়ে বেশি বাগান রয়েছে থানচি ও রুমা উপজেলায়। রাঙামাটিতে কাজুবাদাম উৎপাদন হচ্ছে ২০ হেক্টর জমিতে। এ জেলায় আবাদ বেশি হচ্ছে বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায়। সূত্র আরো জানায়, পাহাড়ের পতিত ভূমিতে সামান্য পরিচর্যায় প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৮ টন কাজুবাদাম পাওয়া সম্ভব। গত বছর বান্দরবানে ৭ দশমিক ২ টন ও রাঙামাটিতে পাঁচ টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়েছে।

পাহাড়ে আরবের খেজুর চাষ

সৌদি আরবের মরুভূমিতে উৎপাদিত খেজুরের পরীক্ষামূলক চাষ করে সফল হয়েছে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, পাহাড়ের মাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে সফল আরবের এই খেজুরের চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশ কৃষি ক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে। পাহাড়ের মাটিতে আরবের এই খেজুর চাষের সফলতায় এখানকার কৃষকদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ। রাঙামাটি রাইখালীর পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ২০০৯ সালে সৌদি আরবের গাছ থেকে প্রায় কয়েকশ বীজ সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে চারা উৎপাদন করে গবেষণার মাঠে রোপণ  করে সফল হন বিজ্ঞানীরা। সব গাছে এ বছর ফুল আসে এবং প্রচুর ফল ধরে যার আকার ও আকৃতি আরবের খেজুরের মতোই খুবই আকর্ষণীয়।

রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের রাইখালীর কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের  সূত্রে জানা যায়, আরবের এই খেজুরের পরীক্ষামূলক চাষের সফলায় পাহাড়ের কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বিদেশি নাশপাতির চাষ

পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি ভূমিতে বিদেশি ফল নাশপাতি চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ড্রাগন, কমলা, রাম্বুটানসহ নানা জাতের বাহারি বিদেশি ফল সমতল ভূমিতে চাষ হলেও শুধু পার্বত্য অঞ্চল ও সিলেটের পাহাড়ি ভূমিতে নাশপাতি চাষের সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। নাশপাতি শীত প্রধান অঞ্চলের ফল হলেও পার্বত্য অঞ্চলের স্বল্প তাপমাত্রা এবং পাহাড়ে ঢালু সমতল অংশে চাষের উপযোগী। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে সফলতা পেয়েছে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালে নাশপাতির জাত অবমুক্ত করেন। যার নামকরণ হয়েছে বারি নাশপাতি-১। অবমুক্তের পর নাশপাতির ফলন পার্বত্য অঞ্চলে চাষের উপযোগিতা পেয়েছে বলে মত দেন সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। এটি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে পার্বত্য অঞ্চলের কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা যুক্ত হবে।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads