• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

অর্থ ও বাণিজ্য

ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর ২০২০

চীন নয়, অর্থনীতির দিক দিয়ে এশিয়ায় বর্তমানে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলো বাংলাদেশ। করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশ হয়তো জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে না। তারপরও যেটুকু অর্জন করবে তা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বেশি, এমনটাই আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকেও বাংলাদেশের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও গত কয়েক বছর ধরেই ভারত থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। 

১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনীতি উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকেই দেশটির স্বপ্ন ছিল চীনের দ্রুত বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা। গত তিন দশক ধরে এজন্য চেষ্টার পরও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে ভারত। আইএমএফের প্রতিবেদন বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তিতে আঘাত লেগেছে। কারণ, এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে অর্থপূর্ণ একটি পাল্টা অবস্থান প্রত্যাশা করে পশ্চিমারা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারত সে প্রত্যাশাটা পূরণ করতে পারছে না।

যে ছোট্ট দেশটিকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন করতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত, এখন ঘরের পেছনের সে দেশটির কাছে ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারত পরাজিত হচ্ছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের প্রভাব ক্ষয়ে আসবে নিঃসন্দেহে। 

গত কয়েক বছরে ভারতের অর্থনীতি অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারীর কারণে তাতে ধস নেমেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে যেন চলতি সপ্তাহে ভারতের অর্থনীতি নিয়ে সব আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশের চেয়ে ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি কম হবে, এমন সংবাদে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ দেশটি।

আইএমএফ তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক আপডেট করার পর এ বিষয়ে এক টুইটে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, কোনো উদীয়মান দেশের অর্থনীতি ভালো হচ্ছে এটা সুখবর। কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো খবর হলো, ভারত এখন পিছিয়ে পড়ছে। পাঁচ বছর আগেও যাদের অর্থনীতি ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল তাদের জন্য এটা মোটেই ভালো খবর নয়।

করোন মহামারীর মধ্যেই চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সম্প্রতি আইএমএফ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এ তথ্য প্রকাশের পর থেকেই প্রশংসায় ভাসছে বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ৮৮৮ ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১০.৫ শতাংশ কমে এক হাজার ৮৭৭ ডলার দাঁড়াতে পারে, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। করোনাভাইরাস মহামারী রোধে দেশব্যাপী কড়া লকডাউনের কারণে তীব্র অর্থনৈতিক সংকোচনে এই প্রবৃদ্ধির হ্রাস ঘটছে।

মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল ভারত। কিন্তু ধারাবাহিক উন্নতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সে ব্যবধান দ্রুত কমিয়ে এনেছে। পিছিয়ে পড়ার কারণ কী, কোথায় ভুল করেছে ভারত, এমন প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছে। অনেকে অবশ্য এজন্য করোনা মহামারীকেই দায়ী করছে। জুনের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। অপরদিকে যে কোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ডের পর ভারতে কয়েকদিন ধরে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। করোনায় এ পর্যন্ত মারা গেছে ৫,৬৪৬ জন মানুষ।  জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে রয়েছে আটগুণ মানুষ। সেখানে মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশের ২০ গুণ। ভারতে লকডাউন জারির কারণে অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বলে দেশটির অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন। তবে করোনা মাহমারী সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো করছে। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ কম দক্ষতাসম্পন্ন পণ্যের রপ্তানি বজায় রেখেছে। এ বিষয়টি গরিব দেশের কর্মবয়সি জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য এগিয়ে আছে ভিয়েতনাম। কিন্তু মৌলিকভাবে, উভয়েই চীনের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। কম দক্ষতাসম্পন্ন পণ্যের উৎপাদনের মাধ্যমে বড় আধিপত্য বিস্তার করে, তারা উচ্চ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।

বর্তমানে ভারতের অর্থনীতি যে অবস্থানে আছে তাতে চীনকে টেক্কা দেওয়ার আগে তাদের অবশ্যই  বাংলাদেশকে পরাজিত করতে হবে। ভারত মূলত উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে, যেমন কম্পিউটার সফটওয়্যার। কিন্তু বিশ্বের কারখানা হিসেবে পরিচিত চীন এখন নিচে বা পিছিয়ে থাকা  দেশগুলোকে সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু স্বাস্থ্যখাতে অথবা সুশিক্ষিত শ্রমের ওপরই নয়, তুলনামূলক সস্তার সুবিধা নিচ্ছে চীন। ব্লুমবার্গের মতামত বিষয়ক পাতার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত বছরের পর বছর ধরে কমপক্ষে ৮০ লাখ কর্মসংস্থানের জরুরি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই ব্যাপক ক্ষতির মুখে রয়েছে। ভারতেও এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপক। বেকার হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। তার সঙ্গে আগে থেকেই থাকা ৮০ লাখ জরুরি কর্মসংস্থানের চাহিদা যোগ হয়ে  ভারতে করোনা পরবর্তী সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণগুলোর একটি হবে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, মাথাপিছু জিডিপির দিক দিয়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় দরিদ্রতম দেশ হবে, যেখানে তাদের পেছনে থাকবে কেবলমাত্র পাকিস্তান ও নেপাল। আর ভুটান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। মহামারীর কারণে শ্রীলঙ্কার পরে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের অর্থনীতি। নেপাল ও ভুটান অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।

পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। তবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশের যৌগিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হারে (সিএজিআর), যা ভারতের ক্ষেত্রে ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে দ্রুত বর্ধমান রপ্তানি খাত, দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হারের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির যথেষ্ট অবদান আছে। বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের রপ্তানির সঙ্গে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে।

উল্লেখ্য, চলিত বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থবছরের বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীনসহ ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। সংস্থাটির গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে। পরবর্তী অর্থবছরে তা আরো কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্বব্যাংক। অবশ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা আছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

এ বিষয়ে সে সময় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেছিলেন, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে চীন, ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তার মতে, বৈশ্বিক নানা সমস্যায় পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতির দেশ এখন কিছুটা স্লো ডাউন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো এগিয়ে চলছে জোর কদমে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড়। এখানে এক টাকা আয় বাড়লে অনেক টাকা বেড়ে যায়। সে কারণে বৈশ্বিক সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে না। করোনা মহামারীর কারণে সে সময়ের পূর্বাভাস থেকে সরে এসেছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

এছাড়া ক্ষুধার সূচকে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রেও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট গত শুক্রবার চলতি বছরের যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উঠে এসেছে ৭৫তম অবস্থানে। অপুষ্টির হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতি অব্যাহত থাকায় ক্ষুধামুক্তির লড়াইয়ে গত এক বছরে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি হলো।

গত বছর এই সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম। তার আগের তিন বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০ নম্বরে। কেবল সূচকের অবস্থানে অগ্রগতি নয়, যে চার মাপকাঠিতে বিচার করে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) করা হয়, তার সবগুলোতেই গতবারের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। সূচকে প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে গত কয়েক বছর ধরেই।

প্রতিটি দেশের স্কোর হিসাব করা হয়েছে ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে। সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়লে বুঝতে হবে, ক্ষুধার রাজ্যে সে দেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমা মানে, সে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ স্কোরের দিক দিয়েও এক ধাক্কায় অনেকটা উন্নতি করেছে। মোট স্কোর গতবারের ২৫.৮ থেকে কমে হয়েছে ২০.৪। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads