সুজন হাজং
আজ তোমাদের রক্তে গোলাপ ফোটে
মৌমাছি গান গায়।
আজ তোমাদের রক্তে সূর্য উঠে
এই সোনার বাংলায়।।
আমার লেখা এই দেশের গানটি গাইতে রাজি হয়েছিলেন কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। গানটির সুর করেছেন যাদু রিছিল। সঙ্গীত করেছেন সুমন কল্যাণ। যাদু রিছিল সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর একজন ভক্ত। আইয়ুব বাচ্চু বলতে তিনি ব্যাপক আবেগাপ্লুত। সুমন কল্যাণ দা’র সঙ্গে বাচ্চু ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল অবিচল আস্থা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার। বলতে গেলে সুমন কল্যাণের সঙ্গীত জীবনে পথ চলার ক্ষেত্রে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন সবচেয়ে বড় আশ্রয়, পথ প্রদর্শক। এমন একটি নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা হারিয়ে সুমন কল্যাণকে আজ খুব অনাথ, অসহায় মনে হচ্ছে। তার চোখের কোণে যে অশ্রু জমে আছে তা যেন এক অবোধ শিশুর।
১০ জন সঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে আমার লেখা দেশের গানের অ্যালবামের কাজ চলছে। যেখানে ইতোমধ্যে আমার লেখা দেশের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফাহমিদা নবী এবং সামিনা চৌধুরী। পছন্দের তালিকায় ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, সুবীর নন্দী, কুমার বিশ্বজিৎ, জেমস, শাকিলা জাফর, বাপ্পা মজুমদার ও আইয়ুব বাচ্চু।
আইয়ুর বাচ্চু? বাংলার সঙ্গীতের আকাশ থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের খসে পড়া। যার দ্যোতি বিস্তৃত হয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে। প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে দিয়ে আমার লেখা দেশের গান গাওয়ানোর স্বপ্নটা ছিল আকাশ ছোঁয়া!
সেই স্বপ্নটা বোধ হয় আজ মিথ্যা হয়ে গেল। আমি যেন সময়ের কাছে হেরে গেলাম। প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর এই মহাপ্রয়াণ মেনে নেওয়া খুব কঠিন। তিনি হয়তো আর কোনোদিন তার রুপালি গিটারের তার ছুঁয়ে যাবেন না। হয়তো আর কোনো মঞ্চে গান গেয়ে অগণিত ভক্তের আবেগের উত্তাল স্রোত তৈরি করবেন না। এখন তিনি থাকবেন আমাদের কালজয়ী সঙ্গীতে বরপুত্র হয়ে। থাকবেন আমাদের চেতনায় সঙ্গীতের চির অমলিন আকাশ হয়ে।
আমার লেখা গানের বিষয় নিয়ে সঙ্গীত পরিচালক সুমন কল্যাণ দা সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন গত ঈদে। তখন তিনি কোরবানির গরু কেনা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। আমার এই দেশের গানের প্রজেক্টটি নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি ঈদের পর যেকোনো এক দিন গানটি গেয়ে দেব।
গানের সম্পূর্ণ মিউজিক করা শেষ হয়েছিল। শুধু কণ্ঠ দেওয়ার বাকি ছিল। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস। গানটিতে তার আর কণ্ঠ দেওয়া হলো না!
এখন কে গাইবে এই গানটি?
এই গানটি আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় তাকেই উৎসর্গ করতে চাই যিনি গাইতে চেয়েছিলেন। সেই প্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রিয় তারকা সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে।
আজ (বৃহস্পতিবার) সুমন দা’র স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। সুমন দা আমাকে দেখেই অঝোরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। মনে হয় যেন তার অভিভাবককে হারালেন। আমিও কাঁদলাম নীরব বেদনায়। আবার কাঁদলাম গভীর রাতে যখন কনসার্টে নগর বাউল জেমসের সকরুণ গিটারের সুর বারবার হূদয় ছুঁয়েছিল এবং যখন তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছিল নীল বেদনায়। মনে হয় ধরিত্রীর বুকে রাতের নির্জনতা তখন আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি।
সুরকার যাদু রিছিল খুব আক্ষেপ করে বললেন বাচ্চু ভাইয়ের ভয়েজটা আমাদের আরো আগে নেওয়ার দরকার ছিল।
কে জানত তিনি এভাবে হঠাৎ সবাইকে কাঁদিয়ে না বলে না ফেরার দেশে চলে যাবেন। সঙ্গীতের চিরসবুজ নায়ক আইয়ুব বাচ্চু। সেই শৈশব থেকেই তার গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। অনেক আবেগ, দরদ এবং মায়া দিয়ে তিনি গাইতেন। জীবনে মাত্র দু’বার এই কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কথা হয়নি। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিশেষ করে সঙ্গীতকে তরুণদের মনে নতুন করে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তার গান তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে শোনা যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন আইডল। আমি মনে করি আইয়ুব বাচ্চু সঙ্গীতের একটি স্কুল, একটি কলেজ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী নতুন নতুন শিক্ষার্থীরা পড়তে আসবে।