• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

বনের এই অংশের গাছ প্রয়োজনে কাটা হলেও বেশিরভাগ স্থানেই বৃক্ষনিধন হচ্ছে বিক্রি বা চাষাবাদের উদ্দেশ্যে

বাংলাদেশের খবর

পরিবেশ

সরেজমিন মধুপুর - ২

মাটি-গাছই বনের শত্রু!

  • শাহনেওয়াজ খান, মধুপুর থেকে ফিরে
  • প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০১৮

প্রবাদ আছে ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’- অর্থাৎ হরিণের সুস্বাদু মাংসই তার শত্রু। ওই মাংসের লোভেই তাকে শিকার করে বাঘ। মধুপুর বনের অবস্থাও তেমনি, উর্বর মাটি ও মূল্যবান গাছের জন্য লোভাতুর শ্রেণির ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের শিকার হচ্ছে।

টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় বিস্তৃত মধুপুর বনের প্রকৃত আয়তন ৪৫ হাজার ৬৫৬ একর। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সরকার এই ভূমিকে মধুপুর বনের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মধুপুর বনের প্রায় ২০ হাজার ৮৪০ একর (৮ হাজার ৪৩৬ দশমিক ১৩ হেক্টর) জমি নিয়ে দেশের প্রথম জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অরণখোলা ইউনিয়নের ৯১৪৫ দশমিক শূন্য সাত একর জমিকে ‘সংরক্ষিত বনভূমি’ ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। তবে বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে চার থেকে সাড়ে চার হাজার একর জমিতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রয়েছে বলে জানান মধুপুরের (টাঙ্গাইল বন বিভাগ) সহকারী বন সংরক্ষক এমএ হাসান।

মধুপুর বনের জমিকে এস্টেট হিসেবে ঘোষণা করে বন বিভাগের অধীনস্থ করেছিল ১৯৫৪ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। বছরের পর বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা এসব জমির বেশিরভাগই এখন লোকজনের দখলে। বসতবাড়ি, ক্ষেত-খামার থেকে শুরু করে হাট-বাজারও গড়ে উঠেছে বনের জায়গায়। অনেকে নবাবদের কাছ থেকে পত্তনি নেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে উত্তরাধিকার হিসেবে মালিকানার দাবিতে মামলা করেছেন। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ মামলা এখনো চলছে। ভুয়া মালিকানা দাবির বেশ কয়েকটি মামলায় পরাজিতও হয়েছে বাদীপক্ষ।

মামলার পাশাপাশি স্থানীয় নৃগোষ্ঠী ও বিভিন্ন সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বনের জমিতে দরিদ্র ও নৃগোষ্ঠীদের জন্য প্লট বরাদ্দের কার্যক্রম নেয় সরকার। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী ও সচ্ছলরা নৃগোষ্ঠীদের অর্থ দিয়ে পরোক্ষভাবে এগুলোর মালিকানা নিয়ে নেয়। বন এলাকার আশপাশের ব্যবসায়ীরাও প্লটগুলোতে কৃষিকাজে নিয়মিত বিনিয়োগ করছেন। বনের জমিতে কংক্রিটের ঘর বানানোর নিয়ম না থাকলেও অনেকেই তা বানিয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এগুলো চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

একই জমিতে একসঙ্গে আনারস, হলুদ, কলা, ধান, লেবুসহ ৫-৬ ধরনের ফল বা ফসল উৎপাদিত হওয়ায় সারা বছরই এই অঞ্চলে চাষাবাদ হয়ে থাকে। স্থানীয়রা ছাড়াও আশপাশের এলাকার অনেক দিনমজুর ক্ষেত ও বাগানে কাজ করে। শুধু বনের পাশেই নয়, ভেতরের অংশেও গাছ কেটে চলছে চাষাবাদ।

এ ছাড়া বনের ভেতরে গজারি, কড়াই, শিমুল, অর্জুন, হরীতকীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান বৃক্ষ রয়েছে। পাতাঝরা এই বনের গাছগুলোর দিকে নজর রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও দস্যুদের। তারা এগুলো কেটে বিক্রি করে দেয়। প্লট বরাদ্দ ও বনের গাছ চুরির পেছনে প্রভাবশালীদের কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেন এমএ হাসান। বেদখল হওয়া বনের জমি উদ্ধার ও গাছ চুরি ঠেকাতে বন অধিদফতর নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

দোখলা রেঞ্জের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসমত আলী জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী ও নৃগোষ্ঠীদের কারণে বেশিরভাগ সময়ই অসহায় অবস্থায় পড়তে হয় বন বিভাগকে। কম লোকবল ও স্থানীয়দের অসহযোগিতার কারণে তারা প্রায়ই বন রক্ষায় উদ্যোগ নিলেও ব্যর্থ হন। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এ ধরনের একটি উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগেরই কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে অবৈধভাবে প্লট লাভ ও গাছ চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। তবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

বনের গাছ চুরি ঠেকাতে কয়েক বছর আগে ‘কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কার’ নামে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। প্রকল্প অনুযায়ী স্থানীয় ‘বৃক্ষচোর’দের বন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। তখন তাদের প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে দেওয়া হতো। দুই-তিন বছর চালানোর পর ওই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই তাদের আগের পেশায় ফিরে যান।

এ ব্যাপারে মধুপুরের সহকারী বন সংরক্ষক এমএ হাসান জানান, ফরেস্ট ওয়ার্কার হিসেবে কর্মরত ‘বৃক্ষচোর’রা কাজের কথা বলে নিয়মিত বনের ভেতরে যেত। সেখানে মূল্যবান গাছ ও এর অবস্থান চিহ্নিত করে দস্যুবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের জানিয়ে দিত। এভাবে বনের অনেক মূল্যবান গাছ চুরি হয়ে গেছে।

গাছ চুরি ঠেকাতে বন বিভাগের কর্মীরা কতটুকু তৎপর- এই প্রশ্নের জবাবে হাসান বলেন, মধুপুরে প্রতিটি রেঞ্জ ও বিট মিলিয়ে মোট ৩০-৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। একেক বিটে সর্বোচ্চ ৩ জন লোক রয়েছে। এত কম লোকবলে এত বড় বনের পুরো অংশে নজরদারি সম্ভব নয়। অনেক সময় গাছ চুরির খবর পেয়ে সেখানে যেতে যেতেই চোররা পালিয়ে যায়।

মধুপুর বনভূমিতে ৩টি রেঞ্জ অফিস ও ১০টি বিট অফিস রয়েছে। পুরো বন পাহারায় কমপক্ষে ২৫০ জন কর্মী প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি। সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করলে এই জনবল সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে সরকার কাজ করছে বলেও জানান বন বিভাগের এই কর্মকর্তা।

হুমকিতে প্রাণীবৈচিত্র্য : বনের জমি বেদখল ও অব্যাহত গাছ চুরির ফলে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে নানা প্রজাতির পশু-পাখি। ইতোমধ্যে চিতাবাঘ, ময়ূরসহ অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সম্প্রতি সরকারের নেওয়া প্রত্যেক বিট অঞ্চলে দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা এ সঙ্কটকে আরো বাড়াবে বলে মনে করছেন এমএ হাসান। এর ফলে বন্যপ্রাণীদের চলাচলের জায়গা আরো সঙ্কুচিত হবে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads