• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

ব্লু-ইকোনমি

সমুদ্র সম্পদে সমৃদ্ধ হোক বাংলাদেশ

  • ফিচার ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৮

সাগরের অজস্র জলরাশি ও এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের স্বপ্নপূরণ ও অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পারে বাংলাদেশ। বিশাল এলাকা নিয়ে সমুদ্র জয়ের পর এবার সে বিপ্লব বাস্তবায়নের রোডম্যাপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সমুদ্র সম্পদের প্রতি নজর দিয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে ঘুরে যাবে দেশের অর্থনীতির চাকা। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে ১৩টি জায়গায় আছে সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালি, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট। অগভীরে জমে আছে ‘ক্লে’। যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, এর পরিমাণ হিমালয়কেও হার মানাবে। এই ক্লে উত্তোলন সম্ভব হলে সিমেন্ট কারখানাগুলো আরো শক্তিশালী হবে বাণিজ্যিকভাবে। এ ছাড়া তেল-গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে সমুদ্রের তলদেশে। সব মিলিয়ে অমিত সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে সমুদ্র সম্পদের সম্ভাবনা। বিশ্বময় আলোচনার কেন্দ্র সমুদ্র অর্থনীতির বাংলাদেশ ও বিশ্ব প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানাচ্ছেন- এসএম মুকুল

 

সমুদ্র অর্থনীতিতে নতুন আশায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী ৩ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আসে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে। গভীর সমুদ্রের ন্যায্য অধিকার পাওয়ায় মৎস্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের টুনা মাছ সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামি এই মাছটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিকমানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা হচ্ছে। টুনা মাছের বিচরণ গভীর সমুদ্রে। মালিকানা অধিকারে বাংলাদেশের ফিশিং ট্রলার এখন গভীর সমুদ্রে টুনাসহ অন্য মাছ আহরণের সুযোগ পাচ্ছে। মৎস্য আহরণের পাশাপাশি সমুদ্র তীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক বিপ্লবের কথা ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও সমুদ্রনির্ভর। আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশই সম্পাদিত হয় সমুদ্রপথে। চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর দিয়ে প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ২ হাজার ৬০০ জাহাজের মাধ্যমে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রফতানি হয়। এসব জাহাজ থেকে ভাড়া বাবদ আয় হয় ৬ বিলিয়ন ডলার। এসব জাহাজের অধিকাংশই বিদেশি মালিকানাধীন। ভবিষ্যতে এসব সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বৃদ্ধি পাবে সে সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বঙ্গোপসারের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে, যা আগামী দিনের জ্বালানি-রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ কারণে এ অঞ্চলটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার অন্যতম জ্বালানি শক্তি বাংলাদেশ। পরবর্তী প্রাকৃতিক গ্যাসের সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আশার খবর হচ্ছে- শুধু গ্যাসই নয়, বঙ্গোপসাগরে ভারী খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারী খনিজের মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিরকন, গার্নেট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এসব সম্পদ থেকে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

 

সমুদ্রের অবদান অসীম-সম্ভাবনা অপার

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে তাকিয়ে আছে সমুদ্র সম্পদের দিকে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। গবেষকরা বলছেন, বিপুল এই জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। আর এ কারণেই ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতিকে গুরুত্বারোপ করার তাগাদা দিচ্ছেন গবেষকরা। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতল থেকে। সমুদ্রের বুকে প্রাপ্ত অনবায়নযোগ্য সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ্য তেল-গ্যাসসহ নানাবিধ খনিজ পদার্থ, যেমন- প্লেসার ডিপোজিট, ফসফরাইট ডিপোজিট, পলিমেটালিক ডিপোজিট, সালফাইড, ম্যাগানিজ নডিউলস ও ক্রাস্ট, গ্যাস হাইড্রেট, এভাপোরাইট ইত্যাদি। জানা গেছে, প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার অন্তত ১.৭৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে। এখানে মোট ১৭ প্রকারের খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮টি অর্থনৈতিকভাবে সক্ষমতা রাখে, যেমন- ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, লিউকোক্সিন, কিয়ানাইট, মোনাজাইট। বিশ্বের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ম্যাগনেশিয়াম সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি সম্ভব। পরবর্তী প্রজন্মের ওষুধ এই সমুদ্র থেকেই পাওয়া যাবে বলে আশা বিজ্ঞানীদের।

 

বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুনমাত্রা

বিশ্বে জনপ্রিয় ইস্যু ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে সমুদ্র সম্পর্কিত বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটছে। ২০০৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার কোটি ইউএস ডলার। ২০২০ সালের মধ্যে তা বেড়ে এক লাখ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয়। বিগত বছরগুলোতে যত আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে তার সবই ব্লুু-ইকোনমি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ২০১২ সালে রিও+২০, সমুদ্রবিষয়ক এশীয় সম্মেলন, ২০১৩ সালে বালিতে অনুষ্ঠিত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ব্লু-গ্রোথ ইত্যাদি সম্মেলনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা (OECD), জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP), বিশ্বব্যাংক, ফাউ (FAO), ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ (EU) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ন কৌশলের মূলেও থাকছে ব্লু-ইকোনমি। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি নানাভাবে অবদান রেখেছে। প্রতিবছর ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগই সমুদ্রনির্ভর। সম্প্রতি দেশটি এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র থেকে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি আয় করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্রনির্ভর ওষুধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব। আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ ব্লু-ইকোনমি নির্ভর উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন করছে। সমুদ্র সম্পদের সমৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে। সমুদ্র বিজয়ে সে সম্ভাবনাকে আরো প্রসারিত।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ২০ ভাগ সামুদ্রিক। আর বিশ্বের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৬ ভাগের অবদান বঙ্গোপসাগরের। আশা করা হচ্ছে, সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এ উৎপাদন আরো বহুগুণ বৃদ্ধি সম্ভব। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রে মাছ আহরণ, সামুদ্রিক খাদ্য ও বাণিজ্যিক সমুদ্র পরিবহন হতে। প্রায় তিন কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, কেবল সমুদ্র অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই বাংলাদেশে যথেষ্ট আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। সমুদ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সাগর থেকে প্রাপ্ত বায়ু, তরঙ্গ, জোয়ার-ভাটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন, লবণাক্ততার মাত্রা ইত্যাদি থেকে বিপুল পরিমাণ নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রতিবছর পৃথিবীতে সমুদ্রবর্তী বায়ু ব্যবহারের সক্ষমতা ৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশকে যদি চীন বা তার মতো বৃহৎ অর্থনীতি থেকে উপকৃত হতে হয়, তাহলে আমাদের চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আধুনিকায়ন করার বিকল্প নেই। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হলেও বিনিয়োগ ও দক্ষতার অভাবে এ সম্পদের সামান্যই অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ খাতের বিস্তৃত সম্পদ অর্থনীতিতে যোগ করতে দরকার আরো দক্ষ জনশক্তি ও বিনিয়োগ। সরকার, বেসরকারি খাত ও গবেষকদের সম্মিলিত উদ্যোগে তা করা গেলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সেই সঙ্গে সমুদ্র সম্পদে সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads