• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ফাইল ফটো

ফিচার

জীবনবাদী কবিতার কবি বেলাল চৌধুরী

  • বঙ্গ রাখাল
  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০১৮

কবি বেলাল চৌধুরীর জগৎ হয়ে ওঠে প্রকৃতি আর মানুষকেন্দ্রিক। যে কারণে শিশুমনেই নানা চিন্তা ও স্বপ্নবাস্তবতা বেলাল চৌধুরীকে প্রভাবিত করেছিল। যেমন বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেনের কালো ধোঁয়া উদ্গীরণ করে চলে যাওয়া, আকাশে উড়ে চলা পাখি কিংবা মাঠে, বিলে, ক্ষেত খামারে কিংবা ছোট ছোট বস্ত্রহীন ছেলেমেয়েদের মাছ শিকার সেই বাল্যেই বেলাল চৌধুরীকে প্রবলভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। যে কারণে বেলাল চৌধুরীর কবিতা একের মধ্যে শত। যেখানে কোনো নিষিদ্ধতা কবির জানা ছিল না। নির্দ্বিধায় কাজ করে যেতে পেরেছেন আর এই বহুমাত্রিক বোহেমিয়ান জীবনের ছাপ মেরে কবিতাকে করে তুলেছেন জীবনবাদী কবিতা। আর এ কারণেই দ্বন্দ্ব জটিল সমাজ, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ, সমাজ মানসের স্বপ্নবাস্তবতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে বেলাল চৌধুরীর কবিতা। তার কবিতা আমাদের মৃত্তিকাকেন্দ্রিক যেখানে সন্ধান মেলে কবির মহিমাদীপ্ত চেতনার সংজ্ঞা, জীবন চেতনা, অনুভূতি, ক্ষোভ কিংবা যন্ত্রণা।

সেই বাল্যেই পরিচিত হয়েছেন সেই সময়ের সব পরিচিত পত্রিকাগুলোর সঙ্গে যে বয়সে এই পত্রিকাগুলো স্পর্শ করা তার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। অল্প বয়সে পত্রিকাগুলো কাছে পাওয়ার কারণে বাল্যেই তার চিন্তা-চেতনার জায়গাটাও হয়ে ওঠে অনেক প্রসারিত আর এই বিদ্যাবুদ্ধিকে সাথী করেই এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে, ক্ষান্তি দেননি। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘অল্প বয়সেই পেকে গিয়াছিলাম বাড়িতে বইয়ের আলমারি আর সিন্দুকের বদৌলতে। যদিও ও দুটোই ছিল আমাদের বয়সীদের জন্য নিষিদ্ধ। আর নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি লোভের কথা কে না জানে। স্বয়ং আদি পুরুষ আদম আর হাওয়াই পারেননি, তা আমরা তো কোন ছার। আব্বা চাকরি করতেন দেশবিভাগের আগে ‘এবিআর’-এ অর্থাৎ আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। চিটাগাং, পাহাড়তলি, লাকসাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, আখাউড়া, কুলাউড়া, লামডিং, মরিয়ানি এসব নাম রূপকার নামের মতো কানে বাজত। আব্বা লাইন থেকে এলে দেখতাম কত রকমের খাবারদাবার ফলমূল আর বই, পত্রপত্রিকা। আমার কাছে সেগুলোর আকর্ষণ ছিল দুর্দমনীয়। ফাঁক পেলেই উলটে-পালটে দেখতাম। আব্বা আড়াল হলে দেখতাম সাপ্তাহিক দেশ, সচিত্র ভারত, ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, বুলবুল, মোহাম্মদী, সওগাত এবং অনেক বইপত্র। আম্মা ছিলেন অতিশয় অগোছালো ধরনের। পড়তে পড়তে এখানে ওখানে ফেলে রাখতেন। সেই অবকাশে বুঝি আর না বুঝি প্রত্যেকটিতে আমার অন্তত একবার ঠোকর মারা চাই-ই-চাই। আর ছিল বাৎসরিক ছুটিছাটাতে বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে আলোক রাতে নানা বাড়ি যাওয়া। সেখানেও অনেক বই ছিল। বিশেষ করে আমার বড় নানা প্রচুর বই পড়তেন। মামারাও বেশ পড়ুয়া ছিলেন। এসব জায়গায় কত ধরনের যে পত্রপত্রিকা খোলামেলা কিংবা বাঁধাই অবস্থায় পেয়েছি তা আর বলার নয়। প্রবাসী, চতুরঙ্গ, উত্তরা, নাচঘর, শিশির আর কত নাম করব।’ (মিশ্রচিত্রপট : বেলাল চৌধুরী)

কবি বেলাল চৌধুরী একজন আশাবাদী এবং স্বপ্নবাজ কবি যে নিজে স্বপ্নের রাজ্যে আবাস গড়েন আবার অন্যের অন্তরে সঞ্চালন করতে পারেন আশা আর চোখের কার্নিশে ভাসাতে পারেন স্বপ্নের ভেলা। কবি যখন উচ্চারণ করেন— একটি পতাকা হতে পারে কত আনন্দের/স্বাধীনতার শব্দটি কত অনাবিল/মুক্তো হাওয়ার পতপত স্বাধীনতার পতাকা/সার্বভৌম, সুন্দর দেশজ চেতনায় রঙে রাঙা/যারা জেনে যেতে পারেনি সেসব দিনের কথা/আজ তাদের প্রাণের অধিক প্রিয় স্বাধীন মুক্ত দেশে/তারাই কি মৃত্যুঞ্জয়ী বীর নয়/যারা পাঞ্জা ধরেছিল মৃত্যুর সঙ্গে/এক ফোঁটা অশ্রুতে সেদিন ঝরেছিল মুক্তো/নিটোল, নিখাদ, রাশি রাশি...(মর্মে মর্েম স্বাধীনতা : জল বিষুবের পূর্ণিমা)। এ কবিতায় কবি যেন বিপ্লবী হয়ে পরিচয় দিয়েছেন কবিসত্তার।

বেলাল চৌধুরী দীর্ঘকাল এক ধরনের নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করলেও যেন বাল্যজীবন তাকে আবেগ-আপ্লুত করে তোলে। পেছন ফিরে দেখায়। যখন তিনি অতীত জীবনে বাল্যময় সেই স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন, তখন তিনি যেন আবার বুকের মধ্যে ভালোবাসা সঞ্চয় করেন। আবার হাঁটতে থাকেন পথ। চোখের সামনে অমলিন হয়ে ধরা দেয় বাল্যের স্মৃতি— ‘চোখের সামনে আজও যেন স্পষ্ট অমলিন/বাল্যকালের গন্ধমাখা আমার নীল জামাটি,/দুরন্তপনার হাজার চিহ্ন আঁকা নীল পতাকা,/রোদে পোড়ায় ঘামে ভেজা হাওয়ায় ওড়া/যেন অস্থির এক প্রজাপতির রঙিন প্রগলভতা;/নীল পাহাড়ের নিরুদ্দেশে মেঘের রেশম স্বাধীনতা;’ (বাল্যকালের গন্ধমাখা নীল জামাটি : যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে)। তিনি নগর জীবনের পিষ্ঠতা, দহনপীড়ন কিংবা গাছগাছালিহীন নগর জীবনে প্রকৃতির যে রুদ্ররোষ তাও তিনি তুলে এনেছেন তার কবিতায়।

কবি বেলাল চৌধুরী ‘ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৯৭), ‘বত্রিশ নম্বর’ (১৯৯৭), ‘সেলাই করা ছায়া’ (২০০৯) কবিতাগ্রন্থে ইতিহাস, মহানায়ক কিংবা ব্যক্তিক ভাবনাগুলোকে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতায় রূপদান করেছেন। নিঃসঙ্গতা মানুষকে চিরদিন কাঁদায়। যে বাড়িতে কোনো মানুষের বসবাস নেই, সেই বাড়ি আজ পাহারা দেয় ফুল, পাখি, বৃক্ষ কিংবা কিছু অযাচিত নামহীন প্রাণী— ‘বত্রিশ বলতে আর একটি সড়ক মাত্র নয়, নয় খালি একটি প্রতীকী সংখ্যা/শুধুমাত্র  একটি সংখ্যাবাচকেই সীমাবদ্ধ নয় এ বাড়ি/যার মাঝে আম জাম শিউলি বকুল ঘেরা/দ্বীপের মতন একটি ভবন যেন এক অনিন্দ্য ভুবন/সাধারণ মানুষের কাছে শেখ সাহেবের বাড়ি নামের উজ্জ্বল বাতিঘর/বরং স্বাধীনতা সৌধের যথাশব্দও বলা যেতে পারে;’ (বত্রিশ নম্বর : যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে)। বেলাল চৌধুরী একজন মানুষকে চিহ্নিত করতে চান একজন বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন বোধের মানুষ হিসেবেই। কবি যখন এই মানুষের বিপর্যয় চিত্র লক্ষ করেন তখনই কুঁকরে যান আর নিজে অস্তিত্ব সঙ্কটে হয়ে ওঠেন একজন বেঁচে থাকার স্বপ্নবাজ কিংবা আশাধারী কাঙাল পুরুষ হিসেবে। এই কবিই আবার আত্মাসন্ধানু হয়ে খুঁজে ফিরেছেন নিজের অস্তিত্ব। ফিরে গেছেন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামগুলোর কাছে, বার বার ফিরে গেছেন যা কবিকে অনুপ্রাণিত করবে। তাই তো মহান নেতার মুক্তিসংগ্রামী জীবনবোধের আবর্তন তার বোধকে আরো শানিত করেছে। যে কারণে একজন বেলাল চৌধুরী বলতে পারেন— ‘বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস খুঁজতে গেলে/যেতে হবে বত্রিশ নম্বর/বাংলাদেশ ও বাঙালির গৌরবগাথা দেখতে হলে/যেতে হবে বত্রিশ নম্বর/বাঙালি ও বাংলাদেশের স্থাপত্য-ইতিহাস জানতে হলে/পাতা উল্টে দেখতে হবে বত্রিশ নম্বর/বাংলাদেশ ও বাঙালির কলঙ্ক চিহ্ন দেখতেও/যেতে হবে সেই বত্রিশ নম্বর...’ (বত্রিশ নম্বর : যে ধ্বনি চৈত্রে  শিমুলে)।

বেলাল চৌধুরীর কবিতায় রয়েছে তার বোহেমিয়ান জীবনযাপন আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিস্তৃত ব্যবচ্ছেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যার মাধ্যমে আমরা তার আত্মোপলব্ধি, মানুষে মানুষে বিরাজমান বৈষম্য কিংবা ক্রান্তিকালের এক বিবেক বিপর্যয়ের সমাজ বা রাষ্ট্রকে দেখতে পাই তার সৃষ্টি দৃশ্যময়তার ক্যানভাসে। নৈঃশব্দ্যের অভাবিত আর্তনাদ কবিকে কখনো বাজিকর, কখনো শব্দের জাদুকর সাজিয়ে চোখের পাতায় ভাসিয়ে তোলেন এক স্নিগ্ধভোর, যেখানে সীমানা থাকে না, পাখির ডানায় ভর করে কবি স্থাপন করেন এক আত্মসংযোগের পৃথিবী। যেখানে হূৎপিণ্ডও সংযোজিত হয়। চাঞ্চল্য সম্পর্কে কবি বিশ্বাসী হয়েই রোপণ করেন স্বপ্নের আলোকচিত্র। অন্তহীন কাঙ্ক্ষা যেন কবির বহুরূপীমনকে বন্দরের নাবিক করে তোলে আর নৌ ভাসাতে শেখায় বন্দর হতে বন্দরে কিংবা গভীর সমুদ্রে। কবির অজানিত পাপবোধের অভিজ্ঞানও যেন নিরাসক্ত মনকে আজ অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে। শ্রদ্ধা ও বিদায় প্রিয় কবি আপনাকে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads