• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

ইতিহাসের জঘন্যতম কয়েকটি গণহত্যা

  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০১৮

গণহত্যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ঘটে, যেখানে এক বা একাধিক মানুষ অন্যদের মেরে ফেলে। আগ্রাসন, মতাদর্শ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত কারণেও গণহত্যা সংঘটিত হয়। পৃথিবীতে বহু অঞ্চল এবং জাতিতে অসংখ্য গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গণহত্যায় শুধু প্রাণে মেরে ফেলাই নয়, অনেক সময় সম্পদ লুণ্ঠনের পাশাপাশি নারীরা ধর্ষিত, এমনকি শিশুরাও নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। গণহত্যার আড়ালে থাকে আসলে একটি জনগোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। পৃথিবীতে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গণহত্যা নিয়ে আজকের আয়োজন-

 

নানকিং গণহত্যা

নানকিং গণহত্যাকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ গণহত্যাকে ‘Rape of Nanking’ বলা হয়ে থাকে। ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জাপানি সেনাবাহিনী চীনের তৎকালীন রাজধানী নানকিংয়ে এ গণহত্যা চালায়। ৬ সপ্তাহ ধরে চলা গণহত্যায় প্রায় ৩ লাখ নিরীহ চীনা জনগণকে হত্যা করা হয়। ব্যাপক লুটপাট ও ধর্ষণের জন্য এই গণহত্যা কুখ্যাত।

মার্কো পোলো সেতু ঘটনার সূত্র ধরে প্রায় দেড় লাখ জাপানি সৈন্য চীনা শহর নানকিং দখল করে নেয়। জাপানি সৈন্যরা কখনো পরিকল্পিতভাবে, কখনো কেবল আনন্দের জন্য নির্বিচারে হত্যা এবং নারীদের ধর্ষণ করেছিল।

সেই সময়ের এক জাপানি সাংবাদিকের বর্ণনায় পাওয়া যায়, জাপানি সেনাবাহিনীর একটি বাহিনীকে এই মর্মে গণহত্যার সম্মতি দেওয়া হয় যে, তারা যত দ্রুত নানকিং পৌঁছতে পারবে তত বেশি লুট ও নারী ধর্ষণের সুযোগ পাবে।

জাপানি বাহিনী নানকিং দখল করার পর সেখানকার সব স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পথে সকল ব্যক্তিকে বেয়োনেট অথবা বিশেষ সামরিক তরবারি দিয়ে হত্যা করে। বহুসংখ্যক চীনাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। ছোট দুগ্ধপোষ্য শিশুদের ওপরে ছুড়ে দিয়ে তরবারি দিয়ে দুই টুকরো করার ঘটনাও ঘটে।

ট্রাইব্যুনালের ভাষ্য ‍অনুযায়ী, জাপানি সেনারা নানকিংয়ে ২০ হাজার নারীকে ধর্ষণ করে। সৈন্যরা প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নারী ও কিশোরীদের ধরে আনত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাপানি সৈন্যরা পরিবারের সদস্যদের একজনকে অপরজনের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতে বাধ্য করে। তারা ছেলেদেরকে মায়েদের ধর্ষণ করতে এবং বাবাদেরকে মেয়েদের ধর্ষণ করতে বাধ্য করে।

চীনা নাগরিকদের ওপর এই ভয়াবহ উৎপীড়নের কারণ পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হয়, সাংহাই দখল করতে প্রচুর লোকবল ও সময় ব্যয়ের কারণে আত্মঅহমিকায় অন্ধ জাপানি বাহিনী প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে এমন কাণ্ড ঘটায়।

এ গণহত্যার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন জাপানি সম্রাট হিরোহিতো। তিনি তার চাচা যুবরাজ আসাকাকে নানকিং অভিযানের নেতা হিসেবে মনোনীত করেন। নানকিং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকেই দায়ী করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের শর্ত অনুসারে জাপানের সম্রাট অথবা রাজপরিবারের সদস্যদের পরবর্তী সময়ে কোনো অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন করা যাবে না, এই শর্তে আসাকাকে কোনো বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি।

 

রুয়ান্ডা গণহত্যা

১৯৯৪ সালের এপ্রিল এবং জুনের মাঝামাঝি ১০০ দিনের ব্যবধানে প্রাণ হারিয়েছিল রুয়ান্ডার প্রায় ৮ লাখ নাগরিক। গণহত্যার স্বীকার হওয়া বেশিরভাগ লোকই ছিল সংখ্যালঘু তুতসি। আর যাদের নেতৃত্বে গণহত্যাটি পরিচালিত হয় তারা ছিলেন হুতু।

নানান খবরের ভিড়ে এই গণহত্যার সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুব কমই স্থান পেয়েছিল। এই সুযোগে গণহত্যা বীভৎস রূপ ধারণ করে। সরকারি নির্দেশেই গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল দুটি হুতু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল- এমআরএনডি (Interahamwe-এর অংশ) এবং সিডিআর (Impuzamugambi-এর অংশ)। রুয়ান্ডার ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ও হুতু পাওয়ার সংস্কৃতির উত্থানের পর সেখানে যে গোষ্ঠীগত ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল তারই চূড়ান্ত পরিণাম এই গণহত্যা। অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল হুতু সরকার ও নির্বাসনে দণ্ডিত তুতসিদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে হুতুদের সহায়তা করেছিল ফ্রান্স ও আফ্রিকার কিছু ফ্রাংকোফোন রাষ্ট্র। আর তুতসিদের সহায়তা করেছিল উগান্ডা। ১৯৯০ সালে হুতুরা আগ্রাসনের মাধ্যমে জয় লাভ করে সরকার গঠন করে। তুতসিরা এতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে বৈদেশিক হস্তক্ষেপে হুতু ও তুতসিদের মধ্যে একটি শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রাথমিকভাবে আরুশা অ্যাকর্ড কার্যকর হয়। প্রথমে মনে হচ্ছিল কূটনৈতিকভাবে বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে সংঘাতের অবসান হতে চলেছে। কিন্তু সরকারের মধ্যে অভিজাত ব্যক্তিরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল।

তুতসিদের দমন করার জন্য হুতুদেরকে ফ্রান্স সরকারের সহযোগিতায় গণহত্যা বিকট রূপ ধারণ করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ফলে হুতুরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের সহায়তায় একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় হুতু শরণার্থীরা দক্ষিণ-পশ্চিমে পালাতে শুরু করে। তুতসিরা তাদের তাড়া করে। ফরাসি অভিযান শেষ হওয়ার পর এই হুতুরা সীমান্ত পেরিয়ে জায়ারে (বর্তমান গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র) আশ্রয় নেয়।

জাতিসংঘ এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক ছিল। এই অনীহার কারণেই রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে গণহত্যা মোকাবেলার মতো যথেষ্ট সৈন্য ও কর্মকর্তা ছিল না।

 

ক্যাটিয়েন গণহত্যা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের ১৬ দিন পরই অন্যদিক থেকে দেশটিতে আক্রমণ করে রাশিয়া। দুই দিক থেকে দুই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আক্রমণে আত্মসমর্পণ না করে উপায় ছিল না পোলিশ বাহিনীর। কিছু পোলিশ আত্মসমর্পণ করে জার্মান বাহিনীর কাছে আর কিছু রাশিয়ানদের কাছে। যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে বেশিরভাগকে ছেড়ে দিলেও ৪০ হাজারের মতো বন্দিকে সোভিয়েতরা ১৯৪০ সাল পর্যন্ত আটকে রাখে।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে সিংহভাগকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয় স্ট্যালিনের নির্দেশে। সব মিলিয়ে ১৪ মিলিটারি জেনারেলসহ পোলিশ মিলিটারির বেশিরভাগ অফিসার, তিন শতাধিক ডাক্তার, কয়েকশ’ আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, দু’শতাধিক লেখক সাংবাদিক, দুই শতাধিক পাইলট, ২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং অর্ধেকেরও বেশি পোলিশ পুলিশ অফিসারসহ ২৫ হাজার ৭০০ জনকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের বেশিরভাগকেই হত্যা করা হয় ১৯৪০ সালে ক্যাটিয়েন নামক একটি বনে। যেহেতু পোল্যান্ডে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু ছিল, তাই বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষই যুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং যুদ্ধবন্দি হিসেবে সোভিয়েতদের কাছে বন্দি হন। তাই স্ট্যালিনের পরিকল্পনা ছিল পোলিশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশকে যদি শেষ করে দেওয়া যায়, তবে জাতি হিসেবে তারা কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না এবং সবসময় সোভিয়েতদের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে হবে।

১৯৪৩ সালে জার্মানি যখন রাশিয়া আক্রমণ করে তখন কিছু পোলিশ রেলওয়ে শ্রমিক ক্যাটিয়েন বনে গণকবর আবিষ্কার করে এবং জার্মানি একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে। রাশিয়া সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে। আমেরিকা, ব্রিটেনের সঙ্গে রাশিয়ার দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে সব সুপার পাওয়ারও তখন এই গণহত্যা নিয়ে নিশ্চুপ থাকে।

পরবর্তী সময়ে পোলিশ সরকারের রুশপন্থি নীতিমালার কারণে নিহতদের স্বজনরা বিচারের দাবি তুললেই রাষ্ট্র কর্তৃক তারা নানা নির্যাতনের স্বীকার হতেন। ১৯৯০ সালে রাশিয়া ক্যাটিয়েন বনে সংঘটিত গণহত্যার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে নেয় এবং দুঃখ প্রকাশ করে। ১৯৯১ সালে এই নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হলেও দোষী ব্যক্তিরা মারা যাওয়ায় ব্যাপারটি বেশিদূর এগোয়নি। ২০১০ সালে রাশিয়া সরকারের নিম্নকক্ষ ক্যাটিয়েন গণহত্যার জন্য স্ট্যালিনকে দায়ী করে বিবৃতি প্রকাশ করে।

বসনিয়া গণহত্যা

১৯৮০ সালে প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল জোসেফ টিটোর মৃত্যুর পর দেশটি ভাঙতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো এবং মেসিডোনিয়া এই ছয়টি দেশে বিভক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে কসোভো, সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে।

জোসেফ টিটোর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন স্লাবোদান মিলোসেভিচ। তিনি ছিলেন জাতিতে সার্বিয়ান। জাতিগতভাবে সার্বিয়ানরা ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টান। অনেক আগে থেকেই সার্বিয়ানদের সঙ্গে জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল ক্যাথোলিক খ্রিস্টান ক্রোট এবং মুসলিম বসনীয়দের সঙ্গে।

১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং অতিদ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই একই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের এপ্রিলে বসনিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বসনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়।

যুগোস্লাভিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মিলোসেভিচ এই স্বাধীনতা ঠেকাতে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো আক্রমণ করে। বসনিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ ছিল বসনিয়াক, ১৭ শতাংশ সার্ব এবং ৩১ শতাংশ ক্রোট। সার্বিয়ান বাহিনী অজুহাত দেখায়, বসনিয়ার নির্যাতিত সার্বদের রক্ষার জন্যই তারা আক্রমণ করেছে। যদিও সেটা ছিল ভুয়া কথা। মূলত তারা জাতিগত নিধনের লক্ষ্য নিয়ে আক্রমণ করে, যা কি না পরবর্তী সময়ে গণহত্যায় রূপ নেয়।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সার্বিয়ান আগ্রাসনে প্রায় দুই লাখ বসনিয়ান মুসলিম মারা যায়। যুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়েছিল ২০ লাখ নারী-পুরুষ। সার্বদের হাতে ধর্ষণের স্বীকার হয় ৫০ হাজার বসনিয়ান মুসলিম নারী।

প্রথমদিকে আমেরিকাসহ অন্যান্য রাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডকে বসনিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। তবে অত্যাচার বেড়ে গেলে বিশ্বনেতারা আর চুপ করে থাকতে পারেননি। তারা সমস্যা সমাধানে হস্তক্ষেপ করেন। ১৯৯৫ সালে ন্যাটোর হস্তক্ষেপে বসনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে ইতিহাসের এক বর্বর গণহত্যার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মিলেসেভিচ, জেনারেল র্যাক্টোসহ ১৬০ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার শুরু হয়। বিচার শেষ হওয়ার আগেই কারাগারে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান মিলোসেভিচ।

 

’৭১-এর গণহত্যা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে বাংলাদেশের ঘুমন্ত নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম নৃশংস গণহত্যা চালায়। এক রাতের মধ্যে সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কয়েক হাজার নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সেজন্য ২৫ মার্চের আগেই ঢাকা থেকে সব বিদেশি সাংবাদিককে বের করে দেওয়া হয়। যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, তারপরও এই হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে চালানো হয়, যার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে পববর্তী পুরো ৮ মাস দুই সপ্তাহ তিন দিন পর্যন্ত। এ কয়েক মাসে পাকিস্তানি বাহিনী মোট ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে, যা নাৎসিদের গণহত্যাকে হার মানায়। ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যা দিয়ে এর শুরু হয়, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে যার শেষ ঘটে। এর মধ্যে গ্রাম-গঞ্জের বহু বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। ধর্ষণ করেছে ২ লাখ নারী।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তা নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটালিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিল ট্যাঙ্ক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে। হল থেকে ছাত্র ও শিক্ষকদের ধরে এনে হত্যা করা হয়। এ রাতেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তান। অন্যদিকে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর চলে ভয়ঙ্করতম গণহত্যা। পরে পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে এ গণহত্যায় যোগ দেয় আধা সামরিক বাহিনী আল-শামস, আল-বদর। তারা গ্রামে-গঞ্জে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবকদের হত্যা করে। বাড়ি থেকে ধরে ধরে এনে যুবকদের লাইন ধরে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের নজির খুব বেশি নেই। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এমন নির্মমতার। গেরিলা এবং সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে একসময় তারা পাক হানাদারদের পরাজিত করে। স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

সম্প্রতি গণহত্যায় পাক হানাদারদের সহযোগিতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের অপরাধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দেশীয় দোসরদের বিচারের আওতায় আনা হয়। গণহত্যার অপরাধে ইতোমধ্যে নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, সাকা চৌধুরী, কামারুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বিচারকার্য এখনো চলমান রয়েছে।

বাবি ইয়ার ম্যাসাকার

বাবি ইয়ার ইউক্রেনের কিয়েভের একটি গিরিখাত। ইতিহাসের জঘন্যতম নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে এখানেই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ১৯৪১ সালে জার্মানির নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারের বাহিনী যোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল শুরুর কয়েক সপ্তাহ পর এই গণহত্যা ঘটে। ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ওই হত্যাযজ্ঞে নিহত হন ৩৩ হাজার ৭৭১ ইহুদি।

ঘটনার তিন দিন আগে কিয়েভে জার্মান এসএসের পুলিশ কমান্ডার মেজর জেনারেল কুর্ট এবারহার্ড এক নির্দেশ জারি করেছিলেন। আদেশটি ছিল এমন- কিয়েভ শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল ইহুদিকে ২৯ নভেম্বর সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে মেলনিকোভা ও দরোহোজিসকা সড়কে ভিস্কোভা গোরস্তানের পাশে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তারা সঙ্গে আনবে দলিল, টাকা, মূল্যবান দ্রব্য, গরম কাপড়, চাদর ইত্যাদি। যেসব ইহুদি এ আদেশ অমান্য করবে, অন্য কোথাও পাওয়া গেলে তাদের গুলি করে হত্যা করা হবে। কোনো বেসামরিক ব্যক্তি যদি ইহুদিদের ফেলে আসা ঘরবাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাদের জিনিসপত্র আত্মসাৎ করে, তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হবে।

জার্মান এসএসের একটি স্পেশাল টিম স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে নির্বিচার গুলিবষণে ইতিহাসের অন্যতম গণহত্যাটি ঘটায়।

হোফার নামে একজন ট্রাক ড্রাইভারের ভাষ্যমতে, জড়ো হওয়া ইহুদিদের প্রথমে নগ্ন হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। নির্ধারিত স্থানগুলোতে তাদের লাগেজ, কোট, জুতো, পরনের কাপড় এবং আন্ডারওয়্যার জমা করতে হয়েছে। নির্ধারিত স্থানে মূল্যবান সামগ্রী জমা পড়েছে। সব ধরনের দ্রব্যের ভিন্ন ভিন্ন স্তূপ। নগ্ন হওয়ার পর তাদের ১৫০ মিটার দীর্ঘ, ৩০ মিটার প্রস্থ এবং ১৫ মিটার গভীর গিরিখাতের তলদেশে নিয়ে উপুড় করে শুইয়ে গুলিবর্ষণ করা হয়। তারপর আরেক দল নগ্ন ইহুদিকে নিয়ে শোয়ানো হয় নিহতদের ওপর। এভাবে ৩৩ হাজার ৭৭১ জনের একটি শবের স্তূপ করা হয়।

এই হত্যাযজ্ঞ থেকে হাতেগোনা যে ক’জন বেঁচেছেন তাদের মধ্যে ২৯ জনকে শনাক্ত করা গেছে। কিয়েভ যতদিন জার্মানির দখলে ছিল, হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে দাবি করা হয়েছে, বাবি ইয়ারে প্রাপ্ত লাশের সংখ্যা এক লাখ। আনাতোলি কুজনেৎসভ দাবি করেছেন, বাবি ইয়ার শুধু ইহুদি কবর নয়, এটি আন্তর্জাতিক কবর। ইউক্রেনিয়ান, রাশান, জিপসি এবং বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ এখানে নিহত হয়েছে।

থিসলনিকীয় গণহত্যা

থিসলনিকীয় ছিল রোমান সাম্রাজ্যের একটি অঞ্চল। ৩৯০ সালে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা  রোমান সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ঘটনার সূত্রপাত খুবই সামান্য কারণে। জনপ্রিয় এক রথচালক সমলিঙ্গের এক ব্যক্তির ওপর যৌন হয়রানি চালানোর অপরাধে অভিযুক্ত হন। সামরিক বাহিনীর প্রধানের আদেশে তাকে আটক করা হয়। কিন্তু, জনসাধারণ তাকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করে। সৈন্যবাহিনী তাকে ছেড়ে না দিলে জনগণ কয়েকজন সৈন্যের ওপর আক্রমণ চলায়। ফলে সামরিক বাহিনীর প্রধান সৈন্যদের নির্দেশ দেন ওই অঞ্চলের ওপর আক্রমণ চালানোর। সৈন্যরা গিয়ে সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং যাকে হাতের কাছে পায় তাকেই মারতে থাকে। এ নিয়ে জনসাধারণ ও সৈন্যদের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াসের কানেও এ খবর পৌঁছায়। তিনিও বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৭ হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হয়।

মিলানের এক পাদ্রী ওই গণহত্যা থামান। থিওডোসিয়া চার্চে ঢুকতে গেলে গির্জার পুরোহিত তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বলেন, তুমি কি জান তুমি কী করেছ? কী সামান্য এক কারণে কত ভয়ঙ্কর রক্তপাত হয়েছে তুমি জান! ঈশ্বর কোনোদিন তোমাকে এ পাপের জন্য ক্ষমা করবেন না। এ কথা শুনে রোমান সম্রাট কাঁদতে থাকেন। কথিত আছে, তিনি একটানা প্রায় সাত-আট মাস গৃহবন্দি থেকে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। এর জন্য রোমান সম্রাট সেই সামরিক প্রধানকেও শাস্তি দেন, যিনি রোমান সম্রাটকে কানকথা শুনিয়ে ভুল পথে চালিত করেছিল। তুচ্ছ কারণে এমন ভয়ঙ্কর গণহত্যার নিদর্শন ইতিহাসে বিরল।

 

এলফিনস্টোন গণহত্যা

এলফিনস্টোন আফগানিস্তানের কাবুল ও জালালাবাদের মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল। ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড এলফিনোস্টোনের নামে জায়গাটির নামকরণ করা হয়। এলফিনস্টোনের নামে মুম্বাইয়ে একটি জনপ্রিয় রেলস্টেশনও আছে। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে মাত্র পাঁচ দিনে এলফিনস্টোন গিরিখাদের সরু রাস্তায় আটকে আফগানরা প্রায় ১৬ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০০ ছিল ব্রিটিশ সৈন্য, ১২ হাজার ব্রিটিশ কর্মচারী ও অন্যান্য সাধারণ নাগরিক। ইতিহাসে এটাই ব্রিটিশদের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম গণহত্যার শিকার হওয়া।

প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে রাশিয়াও আফগানিস্তান দখলে নিতে চেয়েছিল। সেই আশঙ্কা দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আগেই আফগানিস্তান দখল করে। প্রথমদিকে ব্রিটিশরা আফগানিস্তান কাবু করে ফেললেও শেষ দিকে ব্রিটিশদের দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয় আফগানরা। পরবর্তী সময়ে অবশ্য নানা কূটনৈতিক ও সামরিক চাপে আফগানিস্তান ঠিকই হস্তগত করে ব্রিটিশরা। আফগান সেনাপতি আকবর খানের নেতৃত্বে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। ১৮৪২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশরা ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাবে এমন চুক্তিতে কাবুল থেকে জালালাবাদ রওনা হয়। কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করে মাঝপথে তুষারাবৃত গিরিপথ অতিক্রম করার সময় গোপনে আক্রমণ চালানো হয়। এ সময় ব্রিটিশ পক্ষে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৫০০, যার মধ্যে ৪ হাজার ৫০০ জন সৈনিক ও ১২ হাজার সহযোগী কর্মচারী। তাদের মধ্যে হাতে গোনা অল্প কয়েকজনই প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন। ড. উইলিয়াম ব্রাইডন জালালাবাদ ঘাঁটিতে পৌঁছেছিলেন। এ সময় বাহিনীর সদস্যসংখ্যা চল্লিশের নিচে নেমে আসে। লড়াইয়ে ৪৪তম রেজিমেন্ট অব ফুটের প্রায় সবাই নিহত হয়। শুধু ক্যাপ্টেন জেমস সুটার, সার্জেন্ট ফেয়ার ও সাতজন সৈনিক বন্দি হওয়ায় বেঁচে যায়। একই সময় আফগান বাহিনী ব্রিটিশদের অন্যান্য বাহিনীতেও আক্রমণ চালিয়েছিল। ব্রিটিশরা অবশ্য খুব দ্রুত ভারত থেকে সৈন্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads