• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
বেরুচ্ছেন নারী, নিরাপদে ফিরবেন তো

মডেল : প্রিয়াঙ্কা পান্ডে

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

বেরুচ্ছেন নারী, নিরাপদে ফিরবেন তো

  • মনিরা তাবাস্সুম
  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০১৮

বিগত কয়েক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। পথে-ঘাটে প্রতিনিয়ত নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা। বেড়েছে ধর্ষণ, হত্যা এবং গুমের ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই ক্ষতবিক্ষত নারীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে কখনো নর্দমায়, কখনো মাঠে বা ঝোপ-ঝাড়ে।

কাজের প্রয়োজনে সপ্তাহে ৬ দিনই সকাল নয়টায় বেরিয়ে যায় রুবাইয়াত। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কাজের চাপে কখনো কখনো রাতও হয়ে যায়। রুবাইয়াতের বাড়ির বাইরে থাকার সময়টুকু যেন কিছুতেই কাটতে চায় না তার মা আঞ্জুমান বেগমের। তার কেবলই মনে হয়- পথে মেয়ে কোনো বিপদে পড়ল কি না। যুবতী মেয়ে। চারদিকে যে পরিস্থিতি কখন কী হয়ে যায়, কে জানে?

নারীর জন্য ঘরের বাইরে বের হওয়াটাই এখন এক আতঙ্কের। বাড়ি থেকে পড়াশোনা বা কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়া মেয়েটি নিরাপদে বাড়ি ফিরবে কি না তা নিয়ে অভিভাবকের চিন্তার অন্ত নেই। দুশ্চিন্তা না করে উপায়ই বা কী! রোজ পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশন খুললেই চোখে পড়ে হত্যা ও ধর্ষণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বিগত কয়েক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। পথে-ঘাটে প্রতিনিয়ত নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী। বেড়েছে ধর্ষণ, হত্যা এবং গুমের হার। প্রায় প্রতিদিনই ক্ষতবিক্ষত নারীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে কখনো নর্দমায় কখনো মাঠে বা ঝোপ-ঝাড়ে। মেয়েটি ঘরের বাইরে পা রাখার পর থেকেই চাকরিজীবি রুবাইয়াতের মায়ের আত্মাটা যেন হাতের মুঠোয় থাকে। অফিসে ঢোকা থেকে শুরু করে বাসায় ফেরা পর্যন্ত তাই আল্লার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন মেয়ের নিরাপদে ঘরে ফিরে আসার জন্য। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন তো আছেই। প্রতিদিন যে সময় মেয়ে বাসায় ফেরে তার চেয়ে একটু বেশি সময় পেরিয়ে গেলেই মায়ের উৎকণ্ঠা চরমে পৌঁছে। মেয়েকে চোখের সামনে দেখলে বাবা-মা দুজনই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।

রুবাইয়াতের মা আঞ্জুমান বেগম বলেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় থাকি। স্কুল-কলেজে কখনো ওর সঙ্গে যেতে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হয় যদি ওর সঙ্গে অফিস পর্যন্ত যাওয়া যেত। চারপাশে এত অঘটন ঘটে মেয়েদের সঙ্গে, তাতে স্বস্তি পাই না মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে।’

গত বছরের রুপা হত্যার ঘটনাটি বেশ নাড়া দিয়েছিল শাহিনুর আক্তারকে। ময়মনসিংহ শহরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রকল্পে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো শাহিনূরকে।

তবে রুপা হত্যার ঘটনা তাকে ও তার পরিবারকে এতটাই আতঙ্কিত করেছিল যে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাসার পাশের এক কিন্ডার গার্টেনে চাকরি নেন তিনি। রুপা হত্যার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ঘটনা। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আর বাসায় ফেরা হয়নি তার। ময়মনসিংহগামী এক বাসের চালক ও তার সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন রুপা। ধর্ষণের পর হত্যা করে তার লাশটি ফেলে দেওয়া হয় মধুপুর জঙ্গলে। এলএলবি শেষ বর্ষের ছাত্রী রুপা বা তার পরিবারের কেউ কি ভেবেছিল তার আর বাড়ি ফেরা হবে না।

২০১৬ সালে তনু হত্যার ঘটনাটি এখনো ভুলে যায়নি কেউ। সে বছর ২০ মার্চ বিকালে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে টিউশনি করতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি অনার্সপড়ুয়া সোহাগী জাহান তনু। পরবর্তী সময়ে বাড়ির কাছেই তার ক্ষতবিক্ষত লাশ মেলে। তনু হত্যাকাণ্ডটি সে সময় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়। হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে আওয়াজ তোলে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। তবু থেমে থাকেনি নিপীড়নকারীরা। একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে।

শান্তিনগর মোড়ে কথা হয় মেয়েকে কলেজে নিয়ে যাওয়া এক অভিভাবকের সঙ্গে। জুয়েল আহমেদ নামের ওই অভিভাবক জানান, মেয়ে কলেজে পড়লেও রোজ তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনি। ফেরার সময় মা এসে নিয়ে যায়। যত ব্যস্ততাই থাকুক মেয়েকে কখনো একা ছাড়েন না তারা।

তিনি মনে করেন, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এমন ঘটনা বাড়ছে দিনকে দিন।

গত মার্চ মাসে ভিকারুন্নিসা স্কুলের এক ছাত্রীর নিপীড়নের ঘটনার ১০ দিন পার হতে না হতেই আরো একটি নিপীড়নের ঘটনা উঠে আসে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে। ১৭ মার্চ বাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসে নিপীড়নের শিকার হন ইডেন কলেজের এক ছাত্রী।

সেই ছাত্রী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে টিউশনি শেষে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে ‘নিউভিশন’ বাসে চড়েছিলেন তিনি। বাসে ছিল অল্প কিছু লোক এবং পেছনটা ফাঁকা। বাসে থাকা ড্রাইভার-হেলপার থেকে শুরু করে সবাই দুষ্কৃতিকারী। তাদের মতিগতি বুঝতে পেরে চলন্ত বাস থেকেই লাফ দিয়েছিলেন ওই ছাত্রী। আহত অবস্থায় পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েও তিনি কোনো সাড়া পাননি। গত এপ্রিলেও তুরাগ বাসে একই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হন বেসরকারি উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী।

সর্বশেষ এ মাসের শুরুতেই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পাওয়া যায় চট্টগ্রামের সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ। আগের দিন বিকালে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরা হয়নি তারও। এমনকি এটা এখনো জানা যায়নি যে, কীভাবে তার এই করুণ পরিণতি হলো। এ তো শুধু কয়েকটি খণ্ডচিত্র মাত্র। প্রায় প্রতিদিনই অজ্ঞাত নারীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কখনো পরিচয় মিলছে, কখনো শনাক্ত করতে না পারার কারণে বেওয়ারিশ হিসেবে অন্তিম সৎকার করা হচ্ছে।

অসহায় অভিভাবকের এখন দুশ্চিন্তা একটাই- বেরোচ্ছে কন্যা সন্তানটি, নিরাপদে বাড়ি ফিরবে তো?

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads