• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
বৃক্ষ রোপণে সবুজ অর্থনীতি ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস

একটি সার্থক সবুজ বিপ্লবই পারে আমাদের জলবায়ুকে অপরিবর্তিত রাখতে

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

বৃক্ষ রোপণে সবুজ অর্থনীতি ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস

  • প্রকাশিত ০৪ জুলাই ২০১৮

ড. ফওজিয়া ইয়াসমিন

বাংলাদেশের কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রায়ই খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, অসময়ে বন্যা, লবণাক্ততা দেখা দিচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও সবুজ সুরক্ষায় ফলদ বৃক্ষ রোপণ একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। একটি সার্থক সবুজ বিপ্লবই পারে আমাদের জলবায়ুকে অপরিবর্তিত রাখতে। গ্রামসহ শহরকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যাশিত সবুজ প্রকৃতি এবং পরিবেশই পারে বাংলাদেশকে বসবাস উপযোগী করে তুলতে। তাই সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নে বিদ্যমান সমস্যা দূরীকরণে উদ্যোগী হতে হবে আমাদের। কৃষিজমি ছাড়াও পরিকল্পিতভাবে স্থানভেদে বেসরকারি ও সরকারি বাসভবন, দফতর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবনের ছাদ এবং আঙিনা, রাস্তা ও পুকুর পাড়ে আধুনিক জাতসম্পন্ন উপযুক্ত বৃক্ষ বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি/পদ্ধতিতে রোপণ করে সবুজায়িত এলাকার পরিসর অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যদি প্রতিবছর একটি করে গাছের চারা বা কলম রোপণ করেন তাহলে কয়েক বছরে এই গাছপালা বেড়ে সবুজ মাঠ, সবুজ বাসগৃহ, সবুজ কর্মক্ষেত্রে গড়ে উঠবে অর্থাৎ সবুজ গড়ার মাধ্যমে দেশে সবুজ বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে।

সবুজ অর্থনীতি : সবুজ অর্থনীতি হলো সেই অর্থনীতি, যা মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে, পরিবেশগত ঝুঁকি কমাবে ও পরিবেশগত অভাব দূর করবে। অর্থনীতি বিশারদরা পরিবেশগত ঝুঁকি যথাসম্ভব হ্রাস করে মানুষের জন্য উন্নত জীবন-যাপন নিশ্চিত করতে নতুন উন্নয়ন মডেল হিসেবে গ্রিন ইকোনমির উদ্ভাবন করেছেন। আমরা জানি প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে উন্নত সমৃদ্ধ সমাজ, অর্থনীতি, সুন্দর জীবনযাপন সম্ভব নয়। এই ফর্মুলা/নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশের ক্ষতি না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যক্রমকেই সবুজ অর্থনীতি বলা হচ্ছে। যার মাধ্যমে একই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে অর্থনীতি ও পরিবেশের বন্ধন ঘটানো সম্ভব হবে। গ্রিন ইকোনমি বা সবুজ অর্থনীতি স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যেই নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

কার্বন নিঃসরণ : অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রার নাইট্রোজেন, সালফার, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন গ্যাস এবং ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন নিঃসরণের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে শিল্পায়ন, নগরায়ণের কারণে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ফলে উদ্ভিদের নাইট্রোজেন, আয়রন ও জিঙ্ক গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় কৃষিজাত দ্রব্যের গুণাগুণের ওপর বিরূপ প্রভাবসহ কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কার্বন নিঃসরণ কমাতে একমাত্র বৃক্ষই ভূমিকা রাখতে পারে।

চারা রোপণ : বাংলাদেশের বসতবাড়ি এক-একটি অপরিকল্পিত বহুস্তর বিশিষ্ট ফলদ বৃক্ষ চাষ ক্ষেত্র। বহুস্তর বিশিষ্ট দেশীয় প্রচলিত ফল বাগানের বড় স্তরে আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, তাল, খেজুর ইত্যাদি বৃক্ষ, মধ্যম স্তরে পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি এবং নিচের স্তরে আনারস ইত্যাদি চাষ করা লাভজনক। প্রকৃতি এবং এলাকার মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য অনুসারে উন্নত জাতের মানসম্মত সুস্থ চারা বা কলম রোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বহুস্তর বিশিষ্ট ফল চাষ করলে উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব। ফলদ বৃক্ষের উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী বাগান স্থাপন, মাঠ দিবস, ফল গ্রাম, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা করতে ফলদ বৃক্ষের উন্নত জাতের চারা/কলম সংগ্রহ, রোপণ, সার, পানি, ওষুধ প্রয়োগ, আগাছা দমন, অঙ্গছাঁটাই ইত্যাদি পরিচর্যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা দরকার। বাজারজাতকরণ আধুনিকায়ন করতে চারা/কলম নির্বাচনে এ দেশে ৮০ প্রজাতির প্রচলিত ও অপ্রচলিত দেশজ ফলদ বৃক্ষকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।

বাণিজ্যিক সম্ভাবনা  : কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ফল উদ্ভিদের বীজ, চারা, কলম বা প্রপাগিউল আমদানি/রফতানি করা যায়। প্রপাগিউল আমদানির ক্ষেত্রে প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন আইন অনুসরণ করতে হয়। রফতানি আয় বৃদ্ধিতে দেশজ ফলদ বৃক্ষের চারা/কলমের রোপণ ও পরিচর্যার অনেক অবদান আছে। তাই তাজা এবং বিষ ও ভেজালমুক্ত নিরাপদ রফানিযোগ্য দেশীয় ফল, যেসব দেশি ফল সারা বছর ধরে জন্মায় সেসব ফলের কলম/চারা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদনের প্রয়োজন। বৈদেশিক আয় (রফতানি) বৃদ্ধি করতে চারা/কলম রোপণমূলক সচেতনতা ও জোরদারকরণ কার্যক্রমকে কার্যকরী করতে নার্সারি ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ দরকার।

বাণিজ্যিক নার্সারি ব্যবস্থাপনা : ভালো ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানসম্মত চারা ও কলম রোপণ করা। নার্সারি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেখানে ফলদ, বনজ, ভেষজ ও শোভা বর্ধনকারী ফসলের বীজ অথবা অঙ্গজ অংশ থেকে চারা বা কলম উৎপাদন এবং বিপণনের পূর্ব পর্যন্ত পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করা হয়। জাতীয় বীজ বোর্ডের ৫৮তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রণীত নার্সারি গাইডলাইনস ২০০৮ মোতাবেক একটি বাণিজ্যিক নার্সারি স্থাপন করার জন্য চারা বা কলমের গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট মাতৃগাছের উৎস থেকে বীজ, সায়ন, কুড়ি সংগ্রহ করতে হয়। নার্সারির কার্যক্রম সফলভাবে এগিয়ে নিতে হলে উদ্ভাবিত দেশজ ফলের উন্নত জাতের মাতৃকলম সংগ্রহ ও উৎপাদন (বিভিন্ন বংশবিস্তার পদ্ধতি যেমন গ্রাফটিং, গুটি কলম, কাটিং ও বাডিং), মাতৃকলম রোপণ পূর্বক পরিচর্যা (সার, পানি, ওষুধ প্রয়োগ, আগাছা দমন, অঙ্গ ছাঁটাই) এবং মাতৃবাগান ব্যবস্থাপনায় কৃষি বিজ্ঞানী কর্তৃক মালীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অর্থ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য চাহিদা নিবারণে দেশজ ফল চাষের আরো ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য ফলদ বৃক্ষের চারা বা কলমের রোপণ ও পরিচর্যার ওপর ডিএই ও বিএডিসির খামারে কর্মরত ২০০ জন মালী নিয়ে ২০১৬ সালে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মনিটরিং ইউনিট, বিএআরসি ও বারির যৌথ উদ্যোগে কেজিএফের অর্থায়নে গাজীপুর, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও খাগড়াছড়িতে ৫টি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্পন্ন হয়।

বৃক্ষ রোপণে উদ্যোগ গ্রহণ : সরকার সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সারা দেশে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মনিটরিং ইউনিট, বিএআরসি-এর সমন্বয়ে বারি উদ্ভাবিত ফলদ বৃক্ষের মাতৃকলম বা চারা, বিএডিসি ও ডিএই এর উদ্যান খামারে বিতরণ করা হচ্ছে। বিএআরসি কর্তৃক আয়োজিত সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আম, লেবু, আমলকী, কুল, জামরুল, মালটা, লিচু, কামরাঙ্গা, সফেদা, পেয়ারা, আমড়া, আতাফল, বিলাতি গাব, ড্রাগন ফ্রুট ও স্ট্রবেরি ফল ফসলের বারি উদ্ভাবিত মোট ৩২১১টি ফলদ বৃক্ষের মাতৃকলম ও ১৫০০০টি মিষ্টিআলুর ভাইন ৭৮টি হর্টিকালচার সেন্টার, ডিএইতে এবং বিএডিসির ২৩টি উদ্যান খামারে মোট ৯৭৫টি ফলদ বৃক্ষের মাতৃকলম ও ৬৫০০টি মিষ্টিআলুর ভাইন হস্তান্তরের সমন্বয় করা হয়। ইউনিটের মনিটরিং টিম কর্তৃক বিএডিসি, কাশেমপুর ও ডিএই, সাভার উদ্যান খামারে পরীবিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। গত ৬.জুন ২০১৮ এএনটিপি ফেজ-২ এর আওতায় সিআরজি প্রকল্প Development and Upgradation of Digital Contents of National Agricultural Display Center (NADC) at BARC-এর আওতায় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মনিটরিং ইউনিট, বিএআরসি কর্তৃক ৭০০টি প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে ফলবিষয়ক জাত ও জাতভিত্তিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত আছে। যার মাধ্যমে দেশব্যাপী উন্নত জাতের মাতৃকলম বা চারা রোপণ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা দ্রুত ত্বরান্বিত করা সম্ভব। বারি উদ্ভাবিত আরো ফলের চারা কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পিবিআরজি প্রজেক্ট Transfer of Agricultural Technologies to Farmers Level for Increasing Farm Productivity বারি-অংশ এর কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। উন্নতমানের প্রপাগিউল উৎপাদনে, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ওপর সরকারি ও বেসরকারি নার্সারি মালিক, নার্সারিম্যান/গার্ডেনার/মালি/কৃষককে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ‘উন্নত নার্সারি ব্যবস্থাপনা’ গড়া সম্ভব হবে। এজন্য ফল রোপণ শিক্ষার লক্ষ্যে রেডিও, টিভি ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার বাড়াতে হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মনিটরিং ইউনিট, বিএআরসি, ফার্মগেট, ঢাকা

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads