• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
জর্ডানের পেত্রা নগরী

জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পেত্রা শহরটির অবস্থান

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

পবিত্র কোরআনে আলোচিত শহর-১

জর্ডানের পেত্রা নগরী

  • প্রকাশিত ১৩ জুলাই ২০১৮

২০০৭ সালে যখন জর্ডানের পেত্রা নগরীকে বিশ্বের নতুন সপ্তমাশ্চর্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন আমি প্রথম এ নগরী সম্পর্কে জানতে পারি- যদও ১৯৮৫ সাল থেকে এটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেটে ছবি দেখি আর আশ্চর্য হই- গোলাপি পাহাড়ের গায়ে বেলে পাথর (sandstone) কেটে বানানো বিশাল সব গোলাপি বাড়ি। কী সুন্দর! এই শহরের আরেক নামও ‘গোলাপ লাল শহর’ (The Rose Redcity)! এরপর একদিন কোরআন পড়তে গিয়ে একটি আয়াত খুঁজে পাই- আল্লাহ মহানন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আর ছামুদের প্রতি কেমন ব্যবহার করা হয়েছিল, যারা পাহাড়ের উপত্যকায় পাথর কেটে গৃহ নির্মাণ করেছিল!’ (সুরা ফাজর-৮৯)। আয়াতটি পড়ে মনে হলো, আরে এ ধরনের পাহাড়ে পাথর কাটা বাড়ির কথাই তো পত্রিকায় দেখেছি- জর্ডানের পেত্রা! ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি- চার হাজার খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাবাটিয়ান বলে এক যাযাবর আরব জাতি ছিল। পেত্রা ছিল এই নাবাটিয়ান রাজ্যের রাজধানী! একসময় নাবাটিয়ান ও আরব জাতি একই ‘সমার্থক’ হয়ে দাঁড়ায়, যারা ছিল ইসহাকের (আ.) পুত্র। তখন পেত্রার নাম ছিল ‘রাকমু’! গ্রিক ভাষায় ‘রাকমু’ শব্দের অর্থ পাথর। বাইবেলেও এ নগরীর নাম সেলা (Sela) বলে উল্লেখিত হয়েছে। ‘সেলা’ এবং ‘পেত্রা’ দুটির অর্থই পাথর। এই নাবাটিয়ানরাই হলো কোরআনে বর্ণিত সামুদ (Thamud) জাতি এবং জেনেসিস অনুসারে তারা ইসহাক (আ.)-এর পুত্র ‘এশা’র বংশধর (The Edomites)। পেত্রা নগরী লোহিত সাগর আর মৃত সাগরের মাঝখানে এবং আরব, মিসর, সিরিয়া থেকে সুদূর রোমে আসা-যাওয়ার সাধারণ যাত্রাপথের পাশে অবস্থিত। এ রাস্তা দিয়েই উটের কাফেলায় করে চীনের সুতা, সিল্ক আর ভারতের মসলা ও সুগন্ধি এক দেশ থেকে আরেক দেশে আনা-নেওয়া হতো। একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগে তারা সে সময়ের সবচেয়ে ধনী জাতিতে পরিণত হয়েছিল!  শুধু অর্থকড়ি নয় বাণিজ্য সূত্রে পরিচিত হওয়ায় মিসরীয়, রোমানিয়ান, হেলেনেস্টিক ও সিরীয় সবধরনের স্থাপত্য নির্মাণে তাদের অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল আর তারা তা প্রয়োগ করত এই পেত্রাতেই।  

পাহাড় আর পাথর যেন এই সাম্রাজ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শহরের বাড়ি, সমাধি, মন্দির, তিন দিক ঘেরা বিশাল উন্মুক্ত মঞ্চ (amphi theatre), মার্কেট আর কিছুদূর পরপরই সারি সারি সুউচ্চ স্তম্ভ। সবকিছু তৈরি হয়েছে পাহাড়ি বেলেপাথর কেটে কেটে। পানি ছাড়া কোনো শহরই টিকে থাকতে পারে না। পেত্রা নগরীতে পানি সরবারহের ব্যবস্থা দুই হাজার বছর আগেও এতটাই উন্নত ছিল, যা কি-না আধুনিক যুগের মানুষ মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে জানতে পেরেছে। পেত্রার পার্শ্ববর্তী শহর ওয়াদি মুসার (Wadi Musa) পাহাড়ি ৮টি ঝরনা থেকে একটি সুসমন্বিত ১২৫ মাইল দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ পাইপ লাইন বেয়ে এই পানি নগরীর প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে যেত। পেত্রা নগরীর মাটির নিচজুড়ে আজো জালের মতো ছড়িয়ে আছে সেই পানির পাইপ। এছাড়া আরো ছিল পানি জমিয়ে রাখার জন্য ৩৬ট সুউচ্চ বাঁধ!  

প্রতিটি বাড়ির সামনে ছিল সবুজ খেজুরের উদ্যান, স্বচ্ছ নীল পানির পুল! রুক্ষ ও বিরূপ মরুর বুকে তাদের অসাধারণ পানি প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা এই শহরকে বদলে দিয়েছিল এক মরূদ্যানে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা মরুভূমিতে আজকের লাসভেগাস। তারপর হঠাৎ একদিন ২০ থেকে ৩০ হাজার অধিবাসী নিয়ে এই সমৃদ্ধ শহর হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে, পরিণত হয় দ্যা লস্ট সিটিতে!  

এবার এ বিষয়টি নিয়ে পবিত্র কোরআনের দিকে নজর দিই। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমাদের কি পার্থিব ভোগবিলাসের মধ্যে নিরাপদে ছেড়ে রাখা হবে? বাগবাগিচার মধ্যে, ঝরনাসমূহের মধ্যে শস্যক্ষেত্র ও মঞ্জরিত খেজুর বাগানের মধ্যে? তোমরা তো পাহাড় কেটে গৃহনির্মাণ করছ নৈপুণ্যের সঙ্গে!’ (সুরা শুআরা) 

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের এক ভূমিকম্পে এই শহর ধ্বংস হয় এবং হারিয়ে যায়। ৫২০ খ্রিস্টাব্দে এই শহরে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প আঘাত হানে! ১৮১২ সালের আগপর্যন্ত এই শহর পশ্চিমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। সুইস অভিযাত্রী জোহান লুড উইগবার খারদ বেদুইনদের মুখ থেকে হারানো এক শহরের (the lost city) কথা জানতে পারেন এবং প্রাচীন ম্যাপ ও লোকমুখে শোনা কথা মিলিয়ে সেই শহরের খোঁজে এক অভিযানে বের হন। অবশেষে ১৮১২ সালে তিনি এটি খুঁজে পান। শহরটি সহজে খুঁজে না পাওয়ার আরেকটি কারণ ছিল এর অসাধারণ সুরক্ষিত ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। পেত্রা নগরী চারদিক দিয়ে খাড়া পাহাড় ঘেরা এক প্রকাণ্ড দুর্গ-শহর! এমনকি আজকের এই আধুনিক যুগেও পেত্রা নগরীতে কোনো ধরনের যানবাহন ঢুকতে পারে না। শহরে ঢোকার একমাত্র উপায় হেঁটে চলা কিংবা উটের কাফেলা- এটা এতটাই সুরক্ষিত! কিন্তু কীভাবে? এর কারণ হলো ১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাড়া পাথুরে গিরিপথ। যার প্রচলিত নাম সিক (ঝরয়), যা কিনা পেত্রায় ঢোকার একমাত্র পথ এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। ১৯৮৯ সালের চলচ্চিত্র ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্যা লাস্ট ক্রুসেডে’ এই সিক দেখানো হয়েছিল। সিক দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখতে পাওয়া যায় পেত্রার বিখ্যাত ১২৮ ফুট লম্বা আর ৮২ ফুট চওড়া বিশাল সমাধি আল খাজানার (The Treasury)। পেত্রায় এখনো এ ধরনের ১০০টি প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, ভূমিকম্পের অনেক আগেই এ শহরের অধিবাসীরা মারা যায়। কারণ ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের আরো গভীরে পাওয়া গেছে মানুষ ও প্রাণীর হাড়গোড়ের স্তর, যার সময়কাল ভূমিকম্পের সময়কালের থেকে আলাদা। তবে সেটির প্রকৃত কারণ তারা উদ্ঘাটন করতে পারেননি। তাদের মতে, হয়তো কোনো ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’ এজন্য দায়ী।

কানিজ ফাতেমা 

গবেষক ও শিক্ষিকা 

[তথ্যসূত্র: 1. UNESCO.com/Petra. 2. City of Stones.The People of Aad. Part1-4/youtube. 3.  Who were theNabateans?/Nabatea.org. 4.  Petra: Could it be Al Hijras mentioned in theQuran? The Muslims Times. (http//themuslimstimes.info). 5.  The Thamud: Petra and Madain Saleh The Muslims Times. (http//themuslimstimes.info). ৬.  নবীদের কাহিনী।  at-tahreek.com/nobider-kahini. ৭.  আল কোরআন ২৭ (৪৫-৫২), ৭ (৭৩, ৭৫, ৭৭)!] 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads