• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
গ্রাম বাংলার চিরায়ত রূপ

গ্রামীণ জনপদে জলের আরেকটি প্রাচীন বাহনের নাম কলার ভেলা

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

গ্রাম বাংলার চিরায়ত রূপ

  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

বর্ষার বাহন কলাগাছের ভেলা

যদিও নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ- এগুলো জলের প্রধান বাহন। অনেকের জীবনে এসবে চড়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ জনপদে জলের আরেকটি প্রাচীন বাহনের নাম কলার ভেলা। কলাগাছের ভেলায় করে মানুষ নদী বা নাতিদীর্ঘ জলপথ পারাপার হচ্ছে- এমন দৃশ্য বর্ষাকালে বাংলার চিরায়ত ছবি। বিশেষ করে বন্যার সময় যখন রাস্তাঘাট বা বাড়িঘর ডুবে যায়, তখন গরিব মানুষের একমাত্র বাহনে পরিণত হয় কলাগাছের ভেলা। বর্ষাকালে গবাদি পশুর খাবার সংগ্রহ করা হতো এর মাধ্যমে। গ্রামের নারী, পুরুষ ও শিশুরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, স্কুলে ও দূরের বাজারে যাওয়া-আসা করত কলাগাছের ভেলার সাহায্যে। চার-পাঁচটি বা তারও বেশি কলাগাছ একসঙ্গে বেঁধে কলাগাছগুলোতে আড়াআড়ি মোটা শক্ত কাঠি বা বাঁশ দিয়ে গেঁথে নেওয়া হয়, যাতে গাছগুলো বিচ্ছিন্ন হতে না পারে। এভাবে তৈরি করা হয় এক ধরনের অস্থায়ী জলযান- কলাগাছের ভেলা। খরচ ছাড়াই সহজে তৈরি করা যায় বলে গ্রামবাংলায় এর ব্যাপক ব্যবহারের ঐতিহ্য রয়েছে। কলাগাছের ভেলায় করে মানুষ, জিনিসপত্র এমনকি ছাগল ও ছোট গরুর বাছুরও পারাপার করা যায়। একসঙ্গে চার থেকে ছয়জন এতে চড়তে পারে।

বর্ষায় কলাগাছ কেটে পানিতে ভাসিয়ে একসময় তাতে চড়ে দল বেঁধে গোসল করত গ্রামের শিশু-কিশোর-কিশোরীরা। নদীর এপার-ওপার কলাগাছে বসে বাইচ প্রতিযোগিতা হতো। যা ছিল জম্পেশ উপভোগ্য। এই কলাগাছের সাহায্য নিয়ে মাঝনদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতরে বেড়াতাম আমরা। কলাগাছের ভেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ডুবে যাওয়ার কোনো ভয় থাকে না। যারা গ্রামে বড় হয়েছি তাদের স্মৃতিতে কম-বেশি গেঁথে আছে কলার ভেলায় ভেসে বেড়ানোর স্মৃতি। খুব কম হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো কলার ভেলার প্রচলন আছে। কম খরচে তৈরি করা যায় বলে গরিবের জাহাজও বলা হয় কলাগাছের ভেলাকে। স্মৃতির পাতায় আজো ভাসে বর্ষাকালে কলাগাছের ভেলা নিয়ে আনন্দ করার বা ঘুরে বেড়ানোর কথা।

বর্ষার শাপলা-শালুক

বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড় জলাভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান কয়েকটি জলজ উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম হলো শাপলা। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। পানির ওপর ফুটে থাকা শাপলার দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে। শাপলা সাধারণত লাল ও সাদা রঙের হয়। গ্রাম-বাংলার অনেকেই চুলকানি ও রক্ত আমাশয় নিরাময়ের জন্য ঔষধি গুণসম্পন্ন এ শাপলা খুঁজে ফেরেন। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে শাপলার সেই সমারোহ আজ আর নেই।

শাপলার মাথায় এক প্রকার ফুলের মতো গুটি তৈরি হয়, যা গ্রাম-বাংলায় ঢ্যাপ নামে পরিচিত। এ ঢ্যাপের মধ্যে অসংখ্য বীজদানা থাকে। এগুলো রোদে শুকিয়ে চাল তৈরি করা হয়। ঢ্যাপের পুষ্টিকর চাল থেকে তৈরি খই আর নাড়ুর মজাই আলাদা। একসময় বর্ষা মৌসুমে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, রাস্তার দুই পাশে জলাশয়ে ব্যাপকভাবে শাপলার মনোরম দৃশ্য দেখা যেত। শাপলা গাছ ও ডাঁটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। নরম কচি আর খসখসে এ ডাঁটা ঝাল লবণ ও তেঁতুল মাখিয়ে মুখরোচক সবজি হিসেবে গ্রামের মানুষ তাদের রসনাবিলাস করত। তা ছাড়া শাপলার ডাঁটা মাছ-মাংস রান্নার উৎকৃষ্ট সবজি হিসেবে এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়।

শাপলাগাছের গোড়ায় একাধিক গুটির জন্ম হয়, যা শালুক নামে পরিচিত। একেকটি শালুকের ওজন সাধারণত ৪০ থেকে ৭০ গ্রাম হয়। খেতে সুস্বাদু, ক্ষুধা নিবারক ও পুষ্টিকর খাদ্য। শালুক আগুনে পুড়িয়ে কিংবা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। এটি হজমশক্তি বাড়ায়, দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করে এবং শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি জোগায়। একসময় শরতের শেষে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাপলা-শালুক-ঢ্যাপ তোলার ধুম পড়ে যেত। গ্রামে অভাবের সময় অতিদরিদ্র শ্রেণির মানুষ বিল থেকে শালুক তুলে এনে সিদ্ধ করে ভাতের বিকল্প হিসেবে খেত। কালের বিবর্তনে গ্রাম-বাংলার দৃষ্টিনন্দন শাপলা-শালুক আজ বিলুপ্তির পথে।

-ফয়জুন্নেসা মণি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads