• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
মহারাজাদের অনন্যকীর্তি রামসাগর দিঘি

দিনাজপুরের রামসাগর দিঘি

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

মহারাজাদের অনন্যকীর্তি রামসাগর দিঘি

  • দিনাজপুর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৪ জুলাই ২০১৮

ঐতিহাসিক রূপরেখায় দিনাজপুর জেলা প্রত্নতাত্ত্বিক জেলা হিসেবে খুবই সমৃদ্ধ। এই জেলায় নবাবি আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল ও বর্তমানেও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গর্ব করার মতো অনেক নিদর্শন বিদ্যমান। এরই একটি দিনাজপুরের মহারাজাদের অনন্যকীর্তি রামসাগর দিঘি। এটি শুধু ঐতিহাসিক কীর্তিই নয়- প্রাকৃতিক শোভা ও সৌন্দর্যের লীলাভূমিও। দিঘির পাড়ের উচ্চ টিলার উপর অবস্থিত সুন্দর মনোরম ডাকবাংলোটি দেশি-বিদেশি অসংখ্য কৌতূহলী পর্যটকের কাছে যেমন প্রতিনিয়ত স্বপ্নিল আকর্ষণ, তেমনি অনেক রসিক ব্যক্তির কাছেও বটে! এই দিঘির মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্রান্তি ও ক্লান্তি বিনোদনের জন্য সারা বছরে অগণিত ক্লান্ত মানুষ ছুটে আসেন। তারা অনেকে উন্মনা ও উদ্বিগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ান কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পেতে। মরীচিকার হাতছানি এভাবে এসেই যেন থেমে গেছে সবুজের অন্তরে। দিঘির নাম রামসাগর। সাগরের পানির মতো নীল পানি বক্ষে ধারণ করে হ্রদের বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে এর অবস্থান। সাগরের মতো বিশাল না হলেও হ্রদের মতো বড়। দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে এই দিঘির পানিতে মিশে রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস আর কিংবদন্তি।

দিনাজপুরে ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান রামসাগর। দিঘির চারপাশ ঘিরে রয়েছে লালমাটির ছোট ছোট টিলা। এর পরেই সবুজ প্রান্তর। তটভূমিসহ দিঘির আয়তন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩১ মিটার, প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। রামসাগর শুধু দিনাজপুরের নয়, বাংলাদেশের দিঘিগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এই দীঘিকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু কিংবদন্তি ও উপাখ্যান। ইতিহাসের চেয়ে সাধারণ মানুষ কিংবদন্তিকেই বিশ্বাস করে বেশি। কিংবদন্তি অনুসারে পুরাকালে এই অঞ্চলে এক রাজা ছিলেন, নাম প্রাণনাথ। সুশাসক ও প্রজাপ্রিয় রাজা বলে তার দেশজোড়া খ্যাতি ছিল, আর ছিল অফুরন্ত ধনসম্পদ। কিন্তু মনে ছিল না শান্তি। কারণ রাজার ছিল না কোনো পুত্রসন্তান। বহু যাগযজ্ঞ ও দান-দক্ষিণার ফলে অবশেষে দৈবকৃপায় রাজার ঘরে জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। নাম রাখা হলো রামনাথ। যুবরাজ রাম যখন যৌবনে পদার্পণ করে, তখন দেশজুড়ে নেমে আসে প্রকৃতির নিষ্ঠুর তাণ্ডব। শুরু হলো একটানা অনাবৃষ্টি ও খরা। গোটা মৌসুমে একফোঁটা পানিও পড়ল না আকাশ থেকে। অনাবাদি রইল মাঠ। ফসল বা শস্য পাওয়া গেল না একমুঠো। দেশজুড়ে দেখা দিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। অনাহারে মারা গেল শত শত মানুষ। জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হলো রাজভান্ডার। এতে খাদ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও দেখা দিল পানীয় জলের অভাব। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি ও খরায় খালবিল, দিঘিনালা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। একফোঁটাও পানি নেই কোথাও। রাজ্যজুড়ে শুরু হলো পানির জন্য আহাজারি। এমন পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন এক বিরাট দিঘি খনন করার। শুরু হলো দিঘি খনন। হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে খনন করে এক সাগরতুল্য দিঘি। কিন্তু এত গভীর করে খনন করা সত্ত্বেও দিঘির বুকে এলো না একফোঁটা পানি। হতাশা ও দুর্ভাবনায় বৃদ্ধ রাজা আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন। তার মৃত্যুর আশঙ্কায় ঘরে ঘরে শুরু হলো কান্নার রোল। একদিন রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন, তার একমাত্র পুত্র রামকে খনন করা দিঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে। রাজার মুখে স্বপ্নাদেশ শুনে সারা রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। কিন্তু রাজপুত্রের মনে কোনো বিকার নেই। নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রজাদের জীবন রক্ষা করতে রাজকুমার অবিচল। তার নির্দেশক্রমে দিঘির মধ্যস্থলে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করা হলো। এরপর গ্রামে গ্রামে ঢাকঢোল-সহরত বাজিয়ে প্রজাদের জানিয়ে দেওয়া হলো, কাল ভোরে দিঘির বুকে পানি উঠবে। পরদিন ভোর না হতেই রাজবাড়ীর সিংহদ্বার খুলে গেল। বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া। হাতির পিঠে চড়ে শুভ্রবসন পরিহিত যুবরাজ যাত্রা করলেন সেই দিঘির দিকে। দিঘির পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দিঘির তলদেশ থেকে অজস্র ধারায় পানি উঠতে লাগল। চোখের পলকে পানিতে ভরে গেল বিশাল দিঘি। পানিতে ভেসে রইল রাজকুমারের সোনার মুকুট। যুবরাজ রামের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে দিঘির নাম রাখা হলো রামসাগর।

রামসাগরকে পর্যটনের আওতায় নিয়ে আসার পর বন বিভাগের ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গড়ে উঠেছে একটি আধুনিক দ্বিতল ডাকবাংলোসহ সাতটি পিকনিক কর্নার।

১১ রাজার কথা

ঐতিহাসিক ও প্রাচীনতম দিনাজপুর জেলার রাজাদের ইতিহাস খুবই প্রসিদ্ধ এবং ঘটনাবহুল। এই জেলা শাসন করেছেন ১১ রাজা। এই বংশের প্রথম রাজা ছিলেন রাজা সুখ দেব। পরবর্তী সময়ে রাজা রাম দেব, রাজা জয় দেব, রাজা প্রাণনাথ, রাজা রামনাথ, রাজা বৈদ্যনাথ, রাজা রাধানাথ, রাজা গোবিন্দনাথ, রাজা তারকানাথ, মহারাজা স্যার গিরিজানাথ রায় বাহাদুর, মহারাজা জগদীশনাথ রায় বাহাদুর। এ ছাড়াও রাজ কুমার জলধীনাথ ছিলেন এই রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী। তিনিও মহারাজা উপাধিপ্রাপ্ত ছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে দিনাজপুর রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী মহারাজা জলধীনাথ মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads