২০০৯ সালের কথা। মাত্রই কলেজ জীবনের শুরু। একটি টেলিভিশন নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য কয়েক তরুণের প্রয়োজন পড়লে তিনি সেখানে যোগদেন। বেশ কিছুদিন শুটিংয়ের পেছনে ছোটাছুটির পর বুঝতে পারেন ক্যামেরার সামনে যেমনটা দেখানো হয় তার পুরোটায় চালকের আসনে থাকেন পরিচালক। সেই থেকে পরিচালক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েন। ২০০০ সাল থেকে শিশুশিল্পী হিসেবে নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করা ছেলেটির স্বপ্ন বদলে এবার পরিচালক হয়ে ক্যামেরার পেছনে কাজ করার আগ্রহ জেগে ওঠে। পেছনে থেকে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা ছিল বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্র বিষয়ে, কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। ভর্তি হতে হয় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ে। কিন্তু স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বলছিলাম মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাপ্রবি) প্রিয়মুখ মীম নূর হোসেন তূর্যর কথা। বর্তমানে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করলেও তার ধ্যানজ্ঞান জুড়ে কেবলই চলচ্চিত্র। ইতোমধ্যে নিজের পরিচালনায় নির্মাণ করেছেন পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, দুটি ডকুমেন্টারি, সহকারী পরিচালকের ভূমিকায় কাজ করেছেন সাতটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে। এ ছাড়াও কাজ করেছেন প্রায় ১৫টির অধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে।
বাংলাদেশের ফুটবল খেলার সম্ভাবনা এবং এ বিষয়ে তরুণদের আগ্রহ নিয়ে ২০১৪ সালে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের যাত্রাকালেই নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গোল’। এরপর ২০১৫ সালে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে উপলক্ষ করে নির্মাণ করেন নিজের দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সেক্রিফাইস’। যেখানে বিখ্যাত ইংরেজি গল্প ‘দ্য গিফট অব দ্য মেজাই’-এর কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র জিম ও ডেলার ভালোবাসাকে মূলভাব হিসেবে রেখে এক নতুন মাত্রায় দেখানোর চেষ্টা করা হয়। একই বছরের জুলাইতে তিনি দেশের অন্যতম একটি সামাজিক সমস্যা ইভটিজিং নিয়ে নির্মাণ করেন নিজের তৃতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রাজকন্যা’। এ বিষয়ে তূর্য বলেন, মূলত রাজকন্যা চলচ্চিত্রটি ছিল আমার অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। আগের দুটি সিনেমাই মূলত ইউটিউব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু রাজকন্যার মাধ্যমেই আমি প্রথমবার বড়পর্দায় আসার সুযোগ পাই। মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত নতুন চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতা শীর্ষক চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নেয় সিনেমাটি। ইভটিজিংকে নিয়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি পাঠশালা আয়োজিত ছায়াছবি মেলা, চুয়েটের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবসহ মোট ৬টি উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই মুক্তি পায় তার চতুর্থ চলচ্চিত্র ‘শুক্লপক্ষ’। হুমায়ূন আহমেদের স্মরণে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটিতে তিনি হুমায়ূন আহমেদের তৈরি বিখ্যাত চরিত্রগুলোকে একসঙ্গে করে পর্দায় উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। শিল্পকলা একাডেমির এক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত আতিক রহমানের স্ক্রিপ্টে ২০১৮ সালে নির্মাণ করেন ‘বিষকন্যা’। নিজের সিনেমা নির্মাণের গল্প বলতে গিয়ে এ তরুণ নির্মাতা বলেন, মফস্বল শহরে থেকে একটি সিনেমা তৈরির প্রতিটি ক্ষেত্রেই শত-সহস্র বাধা থাকে। ২০১৪ সালে যখন সিনেমা তৈরি শুরু করি, তখন কেউই এ কাজে এগিয়ে আসতে চাইত না। পর্দার সামনে কাজ করতে আগ্রহী ছিল না তেমন কেউ। এখন সেই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও যন্ত্রাংশের স্বল্পতা রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বাজেট স্বল্পতা। টিউশনির জমানো টাকা নিয়ে তৈরি করেছিলেন প্রথম সিনেমা। কোনো ক্যামেরা, ট্রাইপড না থাকা সত্ত্বেও কেবল অন্যের যন্ত্রাংশের সহায়তায় তৈরি করছেন সিনেমা। মৌলিক গল্প নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে এ তরুণ নির্মাতা পরিবর্তন করতে চান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে। এক্ষেত্রে তিনি অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন সত্যজিত রায় এবং তারেক মাসুদকে। এ ছাড়াও তৈরি করতে চান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাস নিয়ে সিনেমা তৈরি হলে তবেই তরুণদের কাছে ইতিহাসকে সহজ করে তুলে ধরা যাবে। তারা এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক মানুষগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করতে শিখবে। এতে করে পুরো একটি প্রজন্ম উপকৃত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংস্কৃতিক অঙ্গনে পা রাখেন ধ্রুবতারা কালচারাল ক্লাবের হাত ধরে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে দর্শক মাতালেও মন পড়ে ছিল চলচ্চিত্রে। এ উদ্দেশ্যেই ২০১৫ সালে কাজ শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটিতে। বর্তমানে তিনি সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ বিষয়ে তূর্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরেই মূলত চলচ্চিত্রে মুক্তভাবে কাজের সুযোগ পাই। সেখান থেকেই ফিল্ম সোসাইটিতে কাজ করা। প্রতিটি কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বাত্মক সহায়তা ও উৎসাহ আমাকে কাজে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। সিনেমার প্রতি ঝোঁক থেকেই অর্থনীতি বিভাগে পড়েও শেষ বর্ষের থিসিসটি করেছেন বাংলাদেশি ফিল্মের কনজিউমার সেটিসফেকশন এনালাইসিস নিয়ে। ভবিষ্যতে দেশের বাইরে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করতে চান মাভাবিপ্রবির এই শিক্ষার্থী। নিজেকে তৈরি করতে চান দেশের অন্যতম সেরা একজন ডকুমেন্টারি ছবি নির্মাতা হিসেবে।