• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ইসলামী দিক-নিদের্শনা

১৭ মাস পর ভেটিং শেষে সেটি আবার মন্ত্রিসভায় তোলা হয়

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ইসলামী দিক-নিদের্শনা

  • প্রকাশিত ১০ আগস্ট ২০১৮

আবু সাঈদ যোবায়ের

সড়ক দুর্ঘটনা- প্রিয়জনের কান্নাজড়িত কষ্টের একটি অধ্যায়। সম্প্রতি কুর্মিটোলায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় বিষয়টি তুমুলভাবে আলোচিত হয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম ইসলাম বেশকিছু সমাধান ও দিক-নিদের্শনা প্রদান করেছে। বিশেষত দুর্ঘটনাকবলিতদের জন্য ইসলামের কালজয়ী সমাধান সবসময়ই উপকারী হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO)-এর Global status report on road safety-এর মতে, বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। ২০১৭ সালেই ৪ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।

নতুন আইন : গত মার্চ ২০১৭-এ মন্ত্রিসভা একটি আইনের খসড়া অনুমোদন করে। সেটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ১৭ মাস পর ভেটিং শেষে সেটি আবার মন্ত্রিসভায় তোলা হয়। ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভা এটি অনুমোদন করে। বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত হলে বা কারো মৃত্যু হলে চালকের সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইনের চূড়ান্ত খসড়ায়। তবে তদন্তে যদি দেখা যায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চালক বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাহলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ সাজা হবে ফাঁসি। তবে এটা তদন্তসাপেক্ষে এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্ধারণ করবে।

ইসলামে ক্ষতিপূরণের ধারণা : ইসলামে এ বিষয়ে ক্ষতিপূরণের বিধান দিয়েছে। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয়, যেকোনো ধরনের ক্ষতির ক্ষেত্রেই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জিরো টলারেন্সে। ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়া পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোরআনুল কারিমেই এ বিষয়টি আমরা পাই- ‘এবং স্মরণ করুন দাউদ ও সুলায়মানকে, যখন তাঁরা শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করেছিলেন। তাতে রাত্রিকালে কোনো সম্প্রদায়ের মেষ ঢুকে পড়েছিল। তাদের বিচার আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৭৮) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর তাবারিসহ মুফাসসিরিন কিরাম একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এক ব্যক্তির শস্যক্ষেতে রাত্রিকালে অপর একজনের মেষপাল ঢুকে তার শস্য খেয়ে ফেলে। দাউদ (আ.) এক্ষেত্রে মেষের মালিককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার মেষপাল বাগানের মালিককে দিয়ে দিতে বলেন। তখন সুলাইমান (আ.) বলেন, আমি মনে করি শস্যক্ষেতের মালিক মেষের দুধ নিতে থাকবে। আর মেষের মালিক শস্যক্ষেতের পরিচর্যা করতে থাকবে। এটি চলবে যতদিন না গাছ বড় হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তখন দাউদ (আ.) তাঁর মত পরিবর্তন করে সুলাইমান (আ.) মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত দেন। এ ঘটনা থেকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝে আসে। এ ছাড়া মহানবী (সা.) বলেছেন, কেউ নিজের ক্ষতি করবে না বা অপরেরও কোনো ক্ষতি করবে না। (ইবনু মাজাহ)। এভাবেই ইসলাম সব ধরনের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর দিবানসহ দিক-নিদের্শনা প্রদান করেছে।

সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ : সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এর ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বেশ কার্যকর। এ বিষয়ে ওআইসি প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফিকহ একাডেমি তাদের অষ্টম সম্মেলনে একটি রেজ্যুলেশন তৈরি করে রেখেছে। এ ছাড়া শাইখ মুস্তাফা আযযারকা ও শাইখ তাকী উসমানী এ বিষয়ে সবিস্তার লিখেছেন। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দুটি অবস্থা হতে পারে- এক. গাড়িচালকের কোনো ধরনের সীমা লঙ্ঘন আছে। দুই. অথবা কোনো ধরনের সীমা লঙ্ঘন নেই। উপর্যুক্ত দুই অবস্থায়ই গাড়িচালক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন, কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা ছাড়া। আন্তর্জাতিক ফিকহ একডেমির মতে, ‘রাষ্ট্রীয় সব ধরনের ট্রাফিক কোড মানতে গাড়িচালক ও গাড়ির মালিক কর্তৃপক্ষ বাধ্য।’ এর মধ্যে গাড়ির ফিটনেস, চালকের ফিটনেস, গতি নিয়ন্ত্রণসহ সব ধরনের ড্রাইভিং কোড এর অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটলে এবং কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়ির চালক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন এবং আইন অমান্যের কারণে বিচারের মুখোমুখি হবেন। সরকারি হিসাবমতে, এদেশে প্রায় ৩২ লাখ নিবন্ধিত গাড়ি রয়েছে। আর বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। প্রায় ৭ লাখ অদক্ষ চালকের হাতে এখনো স্টিয়ারিং। দুর্ঘটনা যেন ঘাপটি মেরে আছে আমাদের পাশেই।

এ ছাড়া এসব কর্মকাণ্ড জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। কোরআন সুন্নাহর পদে পদে জুলুম থেকে বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে। জুলুমের সংজ্ঞা হলো, ‘কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে তার উপযুক্ত মর্যাদায় স্থান না দেওয়া।’ তাই অনুপযুক্ত কাউকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো ইত্যাদি সবই জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। তাই সর্বতোভাবে এসব থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আর যদি গাড়িচালকের কোনো সীমা লঙ্ঘন না থাকে অর্থাৎ তিনি সব ধরনের ড্রাইভিং কোড ও ট্রাফিক কোড মেনেই গাড়ি চালিয়েছেন কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাহলে এক্ষেত্রেও চালক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন। কারণ ইসলামী ফিকহের মূলনীতি হলো ‘আলমুবাশিরুজামিনুন’। যিনি ক্ষতি করেছেন, তিনিই ক্ষতিপূরণ দেবেন। এ বিষয়টিও ওআইসি ফিকহ একাডেমির সিদ্ধান্ত। তবে এক্ষেত্রে তার সীমা লঙ্ঘন না থাকায় তিনি অতিরিক্ত কোনো বিচারের মুখোমুখি হবেন না।

ক্ষতিপূরণ কী হবে : ক্ষতিপূরণ হবে ক্ষতি অনুযায়ী। যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, ততটুকুই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে গাড়ির সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে যেদিক থেকেই কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। কারো আর্থিক ক্ষতি হলে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। অঙ্গহানির ক্ষেত্রেও একই কথা। এক্ষেত্রেও ইসলাম নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। আর মৃত্যু হলে রক্তপণ বা দিয়াত দিতে বাধ্য থাকবে। এটি মূলত ইসলামী শরিয়ার আইন। এ আইনটি বিশ্বের বেশকিছু মুসলিম দেশে বিদ্যমান আছে। সৌদি আরব এর অন্যতম। সৌদি আরবে দিয়্যাত হিসেবে নির্ধারণ করা আছে একশত উটের মূল্য হিসেবে ২ লাখ ৬২ হাজার রিয়াল। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫৫ লাখ টাকা হয়। তবে বাংলাদেশে উটের বাজারমূল্য হিসেবে এই অর্থের পরিমাণ আরো বাড়বে।  সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে চালক এই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী এই অর্থ শুধু চালক একা নন, বরং আকিলাহ পরিশোধ করবে। অর্থাৎ তার পরিবার, বংশ, শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিক কর্তৃপক্ষ সবাই মিলে এই অর্থ পরিশোধ করবে। খুব আস্থার সঙ্গেই বলা যায়, যদি এমন আইন বাস্তবায়ন করা হয়, সবার মাঝেই সচেতনতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

কখন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না : এমন বিশেষ কিছু অবস্থা রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে চালক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নন। যেমন- যদি চলন্ত গাড়ির সামনে কেউ নিজেই এসে পড়ে, এবং এতটাই কাছে থাকে যে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অঙ্গহানি, প্রাণহানি বা বস্তুগত ক্ষতিপূরণ দিতে চালক বা গাড়ির কর্তৃপক্ষ বাধ্য নন।

লেখক : কো-অর্ডিনেটর, ইসলামিক ফিন্যান্স একাডেমি এ্যান্ড কনসালটেন্সি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads