• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
কিচেন কুইন লবি রহমান

বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী লবি রহমান

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

কিচেন কুইন লবি রহমান

  • মনিরা তাবাস্সুম
  • প্রকাশিত ১২ আগস্ট ২০১৮

তিনি চমৎকার করে কথা বলেন। পরিপাটি পোশাকে সদা হস্যোজ্জ্বল মুখ। ভর্তা থেকে মোগলাই, ম্যাক্সিকান থেকে থাই ফুড সবই তার নখদর্পণে। রসুই ঘরের সাধারণ সব উপকরণ তার হাতেই একেকটি অসাধারণ মুখরোচক ডিশে রূপ নেয়। রসুই ঘরের সঙ্গে অনন্য সম্পর্কযুক্ত এ মানুষটি রাঁধুনীদের কাছে এক প্রিয়মুখ। বলছি বাংলাদেশের বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী লবি রহমানের কথা। যিনি তার বৈচিত্র্যময় রান্না আর সাবলীল উপস্থাপনায় জয় করেছেন সবার মন। হয়ে উঠেছেন অনেক নারীর কাছে অনুসরণীয়। বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় তার ক্যারিয়ারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন এই রন্ধনশিল্পী। রান্নায় হাত পাকানো এই রন্ধনশিল্পীর শুরুটা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। তখন কেবল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন। চাঁদরাতে মাকে নানা ধরনের রান্না করতে দেখে ভাবলেন নিজেও রাঁধবেন আজ। কিন্তু মা তো রান্না করতে অনুমতি দেবেন না। তাহলে উপায়! মায়ের রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষায় জেগে রইলেন। অবশেষে মাঝরাতে কাজ শেষে মা ঘুমাতে যাওয়ার পর চুপি চুপি তিনি ঢুকলেন রান্না ঘরে। অন্ধকারেই চুলায় কড়াই বসিয়ে আগুন ধরালেন। তারপর তাতে ঘি ঢেলে দিলেন। আর তখই ঘটল অঘটন। কড়াইয়ে পানি থাকায় ঘি ঢালা মাত্রই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। তার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলেন মা। মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে একদৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাসার ছাদে। সেবার ঈদের দিনটা কেটেছিল ছাদেই। সেই ঈদের স্মৃতি কখনই ভোলার নয়।

আজকের যে লবি রহমানকে আমরা রন্ধনশিল্পী হিসেবে চিনি, মিডিয়ায় তার শুরুটা কিন্তু শিশু শিল্পী হিসেবে নতুনকুঁড়িতে গান, নাচ আর অভিনয়ের মাধ্যমে। তিনি বলেন, কখন যে হারমোনিয়াম ছেড়ে হাতে খুন্তি উঠে এলো বুঝতেই পারলাম না। রান্নায় বরাবরই তিনি শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাছে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন। তার রান্না করা প্রতিটি খাবারের ভূয়সী প্রশংসা করতেন সে বাড়ির সবাই। তার রান্না করা বিরিয়ানির যখন তুলনা হতো হাজির বিরিয়ানির সঙ্গে বিস্ময় আর আনন্দে ভরে উঠত মন। স্বামীর চাকরির সুবাদে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে। যখনই যেখানে গেছেন সেখানেই রান্নার তালিম নিয়েছেন। আয়ত্ত করেছেন নানা দেশের রকমারি রান্না। তখনো তিনি ভাবেননি রান্নাটাকে একসময় পেশা হিসেবে নেবেন। আজ তিনি এ অঙ্গনেই তৈরি করেছেন নিজের আলাদা পরিচিতি। সবার প্রিয় লবি আপা। মিডিয়ায় একজন রন্ধনশিল্পী হিসেবে এতদূর আসার পেছনে পুরো কৃতিত্বই তিনি দেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলা পরিবারকে। এটিএন বাংলাতেই প্রায় তেরো বছর প্রোগ্রাম প্রডিউসার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে পাঁচটি টিভি চ্যানেলে নিয়মিত রান্নার অনুষ্ঠান করছেন তিনি। বিটিভিতে দশ বছর ধরে চলছে তার একক রান্নার অনুষ্ঠান ‘লবির রান্নাঘর’।

প্রতিদিন নিয়ম করে ষোলো ঘণ্টা কাজ করা এ মানুষটি কাজের মধ্যেই বাঁচেন। তবে এত কাজের মধ্যেও ঠোঁটের কোণের হাসিটি বিলীন হতে দেন না এক মুহূর্তের জন্য। বন্ধুবৎসল লবি রহমান সময় পেলেই ঘুরে বেড়ান, মেতে ওঠেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গান আর পুরনো স্মৃতিচারণে। আর সেসব আড্ডার মধ্যমণি যে তিনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এত কাজের পরও ঠোঁটের কোণে এই হাসি কী করে ধরে রাখেন তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বভাবসুলভ হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে বলেন, নিজের দুঃখ, কষ্ট, খারাপ লাগাগুলো প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না আমার। আমি বিশ্বাস করি আমার কষ্টগুলো একেবারেই আমার নিজস্ব। কিন্তু আনন্দগুলোর ভাগীদার আমার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সবাই।

লবি রহমান কুকিং ফাউন্ডেশন

প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এ মানুষটি অনেকটা নিভৃতেই কাজ করে যাচ্ছেন অসহায় দুস্থ নারীদের জন্য। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তিনি লবি রহমান কুকিং ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। যেখানে বছরে চারটি কোর্সে পাঁচজন করে মোট বিশজন মহিলাকে রান্নার প্রশিক্ষণ দেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতে কিছু পরিমাণ অর্থও তুলে দেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারা নিজেরাই বিভিন্ন অফিসে লাঞ্চবক্স দেওয়া ও টিফিন তৈরি করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। তিনি বলেন, আমরা যে যে জায়গায় আছি সেখান থেকে যদি হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে হয়ত আমার পাশের লোকটিও হাসবে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সামনে কাজ করতে চান এতিম শিশুদের নিয়ে। বিভিন্ন এতিখানার ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করার ইচ্ছা রয়েছে তার।

উইমেন কালিনারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ :

বাংলাদেশে প্রথম নারী রন্ধনশিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন কালিনারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। এখানে সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন তিনি। এই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় স্পুন নামের একটি পূর্ণাঙ্গ রেসিপি ম্যাগাজিন। বছরব্যাপী আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা। রান্নার বিভিন্ন কোর্স করানোর পাশাপাশি নেওয়া হয় ফ্রি ক্লাসও।

নিজের রেসিপিতে প্রকাশিত বইসমূহ

২০০৮ সালে প্রথম প্রকাশিত রেসিপির বইটির নাম ছিল রান্না ঘর। এরপর এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা মোট পাঁচটি। রং বাহারি সালাদ, রকমারি ভর্তা, ঝটপট ইফতারসহ রয়েছে আরো দুটি বই। এই বইগুলোর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য তার দশটি রেসিপি নিয়ে ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত বইটি করতে পেরে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান স্পর্শ-এর স্বত্বাধিকারী নাজিয়া জাবিন একদিন জানালেন তার প্রতিষ্ঠানের নারীরাও লবি আপার রেসিপিতে রান্না করতে চান। এরপরই তাদের জন্য ১০টি রেসিপি নিয়ে বের হয় ব্রেইল পদ্ধতির বইটি।

দীর্ঘ পথচলায় ভালোবাসা পেয়েছেন অনেকের। তবে কিছুটা আক্ষেপ করেই বলেন, দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে নিজ হাতে অনেক রন্ধনশিল্পী তৈরি করেছি, কিন্তু যখন দেখি যোগ্য মানুষটি তার যোগ্য মূল্যায়ন পাচ্ছেন না তখন কষ্ট হয়। নতুন যারা এ সেক্টরে আসছে তারা যে সুযোগ পায় আমরা আমাদের সময়ে সেটি পাইনি। কিন্তু আফসোস, তারা এই সুযোগের অপব্যবহারই বেশি করে। তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে- তারা যেন আরো ধৈর্যশীল হন, যত্নবান হন নিজের কাজের প্রতি। 

সময়ের সঙ্গে আপসহীন, পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা সদাহাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত এই মানুষটি ভালো থাকুন সবসময়। ভালোবাসা লবি রহমান আপনার প্রতি। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads