• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
হূদয়পিঞ্জরের স্বভাবপ্রকৃতি

কবি আবুবকর সিদ্দিক

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

আবুবকর সিদ্দিক

হূদয়পিঞ্জরের স্বভাবপ্রকৃতি

  • গোলাম কিবরিয়া পিনু
  • প্রকাশিত ১৮ আগস্ট ২০১৮

কবি আবুবকর সিদ্দিক, তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার কথা মনে হলেই প্রথমত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পটভূমিতে এক কবি-প্রতিকৃতির কথাই মনে পড়ে যায়। ১৯৮০ সালের আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, সেখানে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার আগেই তার কবিতা পাঠক হিসেবে পড়েছি, কবি হিসেবে এক ধরনের আকর্ষণ থাকার কারণে পরবর্তী সময়ে তাকে আবার শিক্ষক হিসেবে পাচ্ছি, তা ছিল ভিন্নমাত্রার এক অনুভূতি। তাকে ক্লাসে পেয়েছি, তার চেয়ে অনেক সময় ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছি ক্লাসের বাইরে, বিভিন্ন কবিতার অনুষ্ঠান আয়োজনে, তার ক্যাম্পাসের বাসায়। পরবর্তী সময়ে রাজশাহীর বাইরে ঢাকায়ও। মূলত কবি হিসেবে তার প্রতি আমার টানটা ছিল অকম্পিত, সে কারণে তার প্রতি প্রতিকর্ষ থেকে যায়।

আবুবকর সিদ্দিক, পূর্ণকালীন কবি ও লেখক। ধারাবাহিকভাবে কবিতা লিখেছেন, এখনো লিখছেন। ৮০ বছর পার করে এখনো লেখায় তিনি সচল। কবিতা ও কথাসাহিত্যে তার সুসিদ্ধি অনেক; কিন্তু সেই তুলনায় প্রসিদ্ধি অনেক কম। কবি হিসেবে তার সফলতা ও কৃতকর্মতা বেশ গভীর, তা মনোযোগের দাবি রাখে কিন্তু তা অবহেলনেই রয়ে গেছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। এরপর বের হয় ‘বিনিদ্র কালের ভেলা’ (১৯৭৬), ‘হে লোকসভ্যতা’ (১৯৮৪), ‘হেমন্তের সোনালতা’ (১৩৯৫), ‘মানুষ তোমার বিক্ষত দিন’ (১৯৮৬), ‘নিজস্ব এই মাতৃভাষায়’ (১৩৯৭), ‘কালো কালো মেহনতী পাখি (১৯৯৫), ‘কংকালে অলংকার দিয়ো’ (১৯৯৬), ‘শ্যামল যাযাবর’ (১৯৯৮), ‘মানবহাড়ের হিম ও বিদ্যুৎ’ (২০০১), ‘মনীষাকে ডেকে ডেকে’ (২০০২), ‘আমার যত রক্তফোঁটা’ (২০০২) এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ।

প্রায় দেড় হাজারের মতো কবিতা তার ছাপা হয়েছে। দুই হাজারের মতো কবিতা তিনি লিখেছেন বলে জানা যায়। তবে সেই সংখ্যা বেশিও হতে পারে। এত কবিতা লিখেছেন, তা সম্ভব হয়েছে— পুরো জীবন লৌহদৃঢ়ভাবে কবিতার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন, পাকাপোক্তভাবে ঘনীভূত করেছেন জীবনের সকল রসায়ন শুধু কবিতার মূলভূমিতে। এই যে কবিতার জন্য নিজেকে অবিভাজ্য রাখা— এ এক কঠিন সাধনার বিষয়। এর জন্য নিজেকে কত কিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছে, পেষণযন্ত্রের মধ্যে পড়তে হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে? কবিদের জন্য এই সমাজ ও সময়কাল কতটুকু সহনশীল? তা কবিমাত্রই জানেন। তবু কবি আবুবকর সিদ্দিক দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘নিজের কথা এইমাত্র সার জানি, আমি এক কবিতার উৎসর্গিতপ্রাণ প্রাণী। এই পরিণত বয়সে সংসারকলত্রবাস্তূঘাট দূরে পাঁচতলার চিলেকোঠায় একাকী সন্নাসবাস এও এক কবিতার সেবাধর্ম মেনে। ...কেন কবিতা লিখি? কবিতা নিয়ে কেন এই অহরহ আর্তি? যখন লিখি না, তখনো কেন কবিতারই বায়ুলোকে নিঃশ্বাস গ্রহণ? সঠিক সদুত্তরটি হয়তো নিজেই জানিনে। এইটুকু বুঝি, কবিতাসংসর্গ আমার জীবনে এক বিশুদ্ধ সংগম। কবিতা লেখাটাই অন্তত আমার কাছে সেরা ভাবে বেঁচে থাকা। জীবনে এমন কিছু নিগূঢ় বোধ আছে, যা শুধু কবিতায়ই অভিব্যক্তি পেতে পারে।’ (আবুবকর সিদ্দিক, শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের ভূমিকা, ২০০২)

কবির এই যে সাধনা, এই যে পথচলার অনুপর্ব, তা এক প্রকৃত কবিরই প্রতিকৃতি মেলে ধরে। আমরা তার কবিতার সূর্যঘড়ি থেকে যে সময়কালের চিত্র খুঁজে পাই, তা কম মূল্যবান নয়, অথচ তার কবিতার আলোচনা গভীর ব্যঞ্জনায় কাঙ্ক্ষিতভাবে উন্মুখ হয়নি। না হওয়ার হয়তো বহুবিধ কারণ আছে। আমাদের খোলা চোখে মনে হয়েছে, তার বন্ধুভাগ্য বড় বেশি সহযোগী হয়ে ওঠেনি, তার জীবন-দর্শনের কারণে প্রতিষ্ঠানেরও আনুকূল্য সেভাবে তিনি পাননি। আর আমাদের সমালোচনার সীমাবদ্ধতার কারণে তার কবিতারও দিগন্ত সেভাবে উন্মোচিত হয়নি। তবে কি তিনি প্রকৃত আলোচক বা সমালোচকের কাছে গিয়ে পৌঁছাবেন না?

কবি আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা বিভিন্ন পর্যায়ে বাঁক নিয়েছে, প্রথম পর্যায়ে কবিতা লিখেছেন অদৃশ্য নারীকে কেন্দ্র করে। তারপর তার বিভিন্ন জনপদের আলেখ্য ও মানুষ। এসেছে দেশের অনুরণিত পরিলেখ। কখনো পুরোগামী হয়ে উঠেছে ব্যক্তিজীবনের বেদনার্ত অভিজ্ঞতা ও হদয়পিঞ্জরের স্বভাবপ্রকৃতি। তার কবিতা পড়তে পড়তে উল্লেখিত দিকগুলোর অনুভব অনুরণিত হয়।

কবি লিখেছেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে : ‘শ্রীমতী তোমার চোখে/অনিহত বিভা আছে/তুমি জানো নাই যাহা/আমি এক নক্ষত্রজলসারাতে/জেনে চলে গেছি।’ (শ্রীমতী তোমার চোখে, ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’)। এই কবিতায় এক ধরনের ভালো লাগার বিভা ছড়িয়েছেন কবি।

তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখলেন : ‘কেউ বলে সংক্রান্তির কাল, কেউ বলে তড়কা রোগের দিন;/পৃথিবী আর নিঃশ্বাস টানতে পারে না,/প্রতিটি শিকড় বেয়ে দুরারোগ্য খিঁচুনি,/পা বললে, চলো।/শেয়াকুলের উপশিরায় এখন ডিহাইড্রেশন,/চাকা খসে পড়ে আছে স্তম্ভিত যুদ্ধক্ষেত্রে,/পা বললে, চলো।’ (হে লোকসভ্যতা, ‘হে লোকসভ্যতা’)। এক ধরনের চিত্রকল্প এই কবিতায় আমরা পাই, কবির কাব্যভাষা এখানে অনেকটা স্বভাবজাত হয়ে উঠেছে। বিষয় ও প্রকরণ উভয়ে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এভাবে তাঁর কবিতা বদলে যেতে থাকে।

পঞ্চম কাব্যগ্রন্থে ভিন্ন এক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মনোরথ পরিব্যাপ্ত করেছেন : ‘শুদ্ধ হতে চাই/পাঁজরের নিচে যতো ঘা পুঁজ চেঁছেপুঁছে নিয়ে/শিল্পীর বাটালি কোঁদা মঠের মতোন আমি/সূক্ষ্ম হতে চাই।/এতো পাপ ধরে না এ বরাদ্দ সময়ে!’ (শুদ্ধ হতে চাই, ‘মানুষ তোমার বিক্ষত দিন’)। এই কবিতার ভেতরে এক ধরনের বোধ দিয়ে নৈতিকতার ভার বহন করতে চান কবি। অনুশোচিত মনোভাব ফুটিয়ে তুলে কবি ভিন্ন ধরনের কাব্যিক-ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন।

দশম কাব্যগ্রন্থে কবি আরো লিখলেন : ‘তোমাকে বুঝতে আমি জলাঞ্জলি দিয়েছি এ/আধখানা মেধাবী জীবন;/ তোমাকে ধরতে আমি আধখানা হূদয়শিলা/ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিই শিমুলের তুলোর মতন।/বাতাস বহনক্ষম নয় এত ভার;/এ যেন দূষিত সীসা, গুহাবন্দী লবণহ্রদ,/এর ছদ্মবেশী গোপনতা নিজেরই লোহু/চেটে চেটে। হায় রক্তরাগ!’ (অভিবাসী, ‘মানবহাড়ের হিম ও বিদ্যুৎ’)। এই কবিতায় উপমা ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা কবিতার মর্মস্থলকে আরো আত্মভেদী করে তোলে।

কবি আবুবকর সিদ্দিকের কবিতার অন্তর্জগৎ ও তার গতিপ্রকৃতি বিস্তৃত অবস্থান নিয়ে দেদীপ্যমান, এত অল্প পরিসরে তা ব্যাখ্যা করা সমীচীন নয়; আরো মনোযোগ, আরো বিশ্লেষণ দাবি করে। আমিও অপেক্ষায় থাকলাম ভবিষ্যৎ কোনো এক প্রকৃত সমালোচকের জন্য, তিনি তাঁর মেধা দিয়ে এই কবিকে প্রকৃত মূল্যায়নে আবিষ্কার করবেন। আমার একজন শিক্ষক বলে নয়, প্রথমত তাকে কবি হিসেবে কাছে পাই, এতকাল পরেও তাকে কবি হিসেবেই শ্রদ্ধা জানানোর জন্য খানিকটা স্বরূপ খুঁজে পেলাম। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads