• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
উত্তাল ’৭১-এর ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’ সন্ধ্যা রানী সাংমা

সন্ধ্যা রানী সাংমা

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

উত্তাল ’৭১-এর ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’ সন্ধ্যা রানী সাংমা

  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৮

হাবিবুর রহমান, মধুপুর

সময়টা ১৯৭১। থেমে থেমে বৃষ্টির মতো গুলি। চারদিকে লাখো মানুষের আর্তনাদ, খাদ্যসঙ্কটে হাহাকার। মা-বোনেরা দিশাহারা নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষায়। বুকের শিশুকে হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে মায়ের সর্বোচ্চ সতর্কতা আর সন্তান হারানো মায়ের আহাজারি। পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর জীবন-মরণ লড়াই। এ শুধু নিজেকে নয়, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে বাঁচানোর আমরণ সংগ্রাম। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এদেশের ঘাটের মাঝি, বাংলার রাখালসহ অজস্র মায়ের দামাল সন্তান। এ সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল মধুপুর গড়ের আদিবাসী নারী সন্ধ্যা রানী সাংমা। ’৭১-এর রণাঙ্গনে সেবিকা হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে গেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। যে সময় প্রাণরক্ষার্থে বহু মানুষ পালিয়ে বেড়াতো, সে সময় একজন আদিবাসী নারী হিসেবে যুদ্ধে সশরীরে উপস্থিত থেকে সেবা দেওয়া মোটেও সহজ কথা নয়। এজন্য দরকার অসীম সাহস আর অকৃত্রিম দেশপ্রেম। 

সন্ধ্যা রানীর সঙ্গে কথা হয় নলছাপড়া গ্রামে তার নিজ বাড়িতে। তার মুখেই জানা যায় তার জীবন ও মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনী। তিনি কলমাকান্দায় বসবাস করলেও তার জন্ম মধুপুর গড়ের জাঙ্গালিয়া গ্রামে। ১৯৫৪ সালে গড় এলাকার অরণ্যঘেরা সবুজ নলছাপড়া পল্লীর এক আদিবাসী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জমির মারাক ও মা রীনা মণি মৃ। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এ পরিবারটিতে ছিল অনাবিল সুখ-শান্তি। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হলেও বাবা-মা তাকে জলছত্র মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বন্যপ্রাণীর আক্রমণের ভয় থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতিদিন জাঙ্গালিয়া গ্রাম থেকে হেঁটে জলছত্র মিশনারি স্কুলে যেতেন পড়তে। জলছত্র মিশনারি স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। সে সময় নারীশিক্ষার প্রতি এমনিতেই কোনো জোরাজুরি ছিল না; আদিবাসী পরিবারগুলোতে তো নয়ই। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে দূরে ভর্তি না করিয়ে পাশের গ্রাম ভুটিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। পরে ভুটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এভাবে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর ১৯৬৯ সালে হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন। সঙ্গে ছিলেন আরো এক আদিবাসী মেয়ে বেরুনিকা সিমসাংও। প্রথম বর্ষ পরীক্ষায় দুজনেই কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। পুরোদমে চলে তাদের পড়াশোনা। মনোযোগী হন পাঠে। দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময় পুরো দেশ তখন উত্তাল। তিনি জানান, তখন মার্চ মাস, ট্রেনিং সেন্টারে থাকতে না পেরে সবাই বাড়ি চলে যাচ্ছিল। কোনো উপায়ন্তর না দেখে ট্রেনিং সেন্টারের ডা. পাইস্যার, ডা. মেসকন, ডা. রনকিব ও ডা. পীযূষ কান্তি রায়ের সঙ্গে থেকে যান। পরে ভারতে পানিহাটা মিশনে গিয়ে আশ্রয় নেন। এক রাতে সেখান থেকে চলে আসেন বারোমারি মিশনে। সেখানে সপ্তাহ খানেক থাকেন। সেখানে সেবিকাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধাহতদের সেবা দেন। সেখানেও থাকা হলো না বেশিদিন। এরপর নানা সময় নানা জায়গা ঘুরেছেন। যেখানেই গেছেন, অস্থায়ীভাবে যেভাবে থেকেছেন হতাহত মুক্তিসেনাদের সাহায্য করেছেন। অবশেষে নার্সিং  ট্রেনিং সেন্টারের ডাক্তার পীযূষের সঙ্গে (ভারতের) এক মাইল পশ্চিমে ১১ নং সেক্টরের ফিল্ড হাসপাতালে যান। সেখানে ডা. প্রেমাংক রায়, ডা. আবদুল মান্নান, ডা. দুলাল, ডা. মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে রোগীদের সেবা দিতে থাকেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, কলেরা রোগীসহ নানা রোগের সেবা দিতেন। প্রতিদিন সেবা চলত সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং ১২টা থেকে ভোর ৪টা পযন্ত। বাঁশের বেড়ায় ঘেরা ৪৫ শয্যার হাসপাতালটিতে ছিল না কোনো আলোর ব্যবস্থা। তিনি জানান, হ্যারিকেনের আলোয় অপারেশন করা হতো। রাতে টর্চলাইট দিয়ে সেবা দিতাম। সেই হাসপাতালেই সেবা দিয়েছেন ২৯ দিন। নভেম্বর মাসে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ধানোয়া কামালপুর আসেন। কামালপুর সীমান্তে তখন পাকিস্তানিদের বাংকার ছিল। সেখানে অনেক লোককে মারা হয়। বাংকার থেকে পাঞ্জাবিদের বিদায় করার জন্য শ্যালো মেশিনে পানি দিয়ে ভরে দিয়েছিলেন বাংকার। স্মৃতি হাতড়ে আরো জানান, জামালপুরের বকশিগঞ্জের মাঠেই তাঁবু করে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে থাকি। জীবনটা তখন হাতের মুঠোয় ছিল। শত্রুরা মাইন ফেলে আক্রমণ করত, কানের কাছ দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দ করে ছুটে যেত গুলি। শেরপুর ও জামালপুরের ঘাঁটিতে যুদ্ধশেষের দিনগুলোতে ছিলেন তিনি ও বেরুনিকা সিমসাংও। সন্ধ্যা রানীর স্মৃতিতে সে দিনটি আজো অমলিন হয়ে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের সবুজের মধ্যে লাল-সাদা পাড়ের কাপড় পরিয়ে প্রাইভেটকারে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। দীর্ঘদিন বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকায় বাড়ির লোকজন ধরেই নিয়েছিলেন যে সে মারা গেছে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, যুদ্ধ চলাকালীন বকশিগঞ্জের অস্থায়ী ক্যাম্পে সেবিকা হিসেবে কাজ করার সময় সেদিন হয়তো মরেই যেতাম। সেদিন আমাদের তাঁবু লক্ষ্য করে বোমা ফেলা হয়েছিল। আমাদের ওপর বোমা ফেলা হয়েছিল। বোমার আঘাতে জ্ঞান হারালেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই আমি। সবাই ভেবেছিল সন্ধ্যা রানী মারা গেছে। ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেন। যখন যুদ্ধের কথা মনে হয় চোখে জল আসে। হতবাক হয়ে যাই। তিনি আরো জানান, যুদ্ধের সময় পুরো ৯ মাস প্রায় এক কাপড়েই কেটেছে। দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে না খেয়ে। সে দিনগুলোর সব কষ্টই তিনি ভুলেছেন স্বাধীন দেশ পেয়ে। সন্ধ্যা রানী সাংমা আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন অজস্র সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। পাক্ষিক অনন্যা শীর্ষ দশ, কারিতাস, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ, ’৭১-এর নারী ও জালাল উদ্দিন ফাউন্ডেশন থেকে আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন। বর্তমানে ৬২ বছর বয়সী সন্ধ্যা রানীর শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নেই। বিটিভির ‘দেশটাকে ভালোবেসে’ নামের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডে আঘাত পান। এতে মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর কিছুটা অসহায় হয়ে পড়লেও একা হাতে মানুষ করেছেন সন্তানদের। এখন শারীরিক অসুস্থতা ছাড়া আর কোনো কষ্ট নেই। তার বাড়িতে আছে পাকা ঘর আর টিনের ঘর। গোয়ালভরা গরু। পুকুরভরা মাছ। শাকসবজি আবাদ করেন। কিনতে হয় না। তিনি বলেন, আমার মন যখন খারাপ হয় তখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। সন্ধ্যা রানীর কোনো আক্ষেপ, নেই কোনো অনুশোচনা। আছে শুধু দেশপ্রেম আর ভালোবাসা। আগামী প্রজন্ম দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসবে- এটাই তার একমাত্র কামনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads