• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
১০ হাজার শিশুকে আলোর মুখ দেখিয়েছেন যিনি

প্রৌঢ় গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ইশরাত জামান

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

১০ হাজার শিশুকে আলোর মুখ দেখিয়েছেন যিনি

  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৮

ফয়সল আহমেদ খান, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

যখন একটি শিশু জন্ম নেওয়ার সময় হয়, তখন সব গর্ভবতী মায়ের পাশেই অভিজ্ঞ একজন ধাত্রীর প্রয়োজন পড়ে, যিনি নতুন শিশুটিকে ভূমিষ্ঠ হতে সাহায্য করেন। যার কোমল আদরমাখা হাতের স্পর্শে পৃথিবীর প্রথম আলোর মুখ দেখে নতুন শিশু। তেমন একজন মানুষই হলেন ফাতেমা বেগম। ব্র্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য সহকারী (এফডব্লিউএ), যিনি সবার কাছে ফাতেমা আপা নামেই পরিচিত। ১৯৮১ তিনি সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৮৮ সালে বাঞ্ছারামপুরে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ পান। মিসেস ফাতেমা বেগমের জন্ম বাঞ্ছারামপুর সদর পৌর এলাকার বড়বাড়ী মহল্লায়। স্বামী মোহাম্মদ হোসেন পেশায় একজন দলিল লেখক (মোক্তার)। ফাতেমা বেগম ১৯৮৮ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই ধাত্রীবিদ্যায় বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিবন্ধিত ধাত্রী হিসেবে গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করিয়ে আসছেন। চারদিকে যখন সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবের হিড়িক, সেখানে তিনি মায়েদের এবং তার পরিবারকে নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে উৎসাহিত করে থাকেন। চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সরকারি রেজিস্টার ও ব্যক্তিগত হিসাব মিলিয়ে তিনি প্রায় ১০ হাজারের অধিক নারীর সন্তান প্রসবে ধাত্রী হিসেবে সহায়তা করেছেন বলে জানান। যেটি নিঃসন্দেহে এক অনন্য রেকর্ড, যা কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নয়- পুরো বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ধাত্রী হিসেবে নতুন নাম সংযোজন হয়েছে বলে মনে করেন প্রৌঢ় গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ইশরাত জামান।

ডা. ইশরাত জামান বলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে হসপিটালের বাইরে মফস্বলে এত অধিক সংখ্যক শিশু জন্মদানে সহায়তাকারী হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফাতেমা বেগম সেরাদের সেরা বলেই মনে হচ্ছে। শুধু স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান প্রসব করানোতেই থেমে নেই তিনি, গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন পরামর্শও দিয়ে থাকেন। ফাতেমা বেগম জানান, ‘যখন কোনো নারী গর্ভবতী হয়, তখন থেকেই আমি তাদের আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে শুরু করি বিনামূল্যে। নিজে যেচে যাই গর্ভবতী মায়েদের ঘরে ঘরে। এটা আমার অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিষয়ে। যখন নতুন মা চিহ্নিত হন, তখন তার কাছে বা তার স্বামী, শাশুড়ি বা অভিভাবকের কাছে নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে বুঝিয়ে বলি এবং হবু মাকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করি। কারণ নরমাল ডেলিভারি নিয়ে এখন অনেকের মধ্যেই ভীতি লক্ষ করা যায়। তাই নরমাল ডেলিভারির বিভিন্ন সুবিধার বিষয়ে তাদের জানাই এবং আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। এটা আমার রুটিনওয়ার্ক। যখন গর্ভবতীদের সঙ্গে কথা হয়, তখন গর্ভবতীদের কী খেতে হবে, কী খাবেন না, কী কী করণীয় ইত্যাদি পরামর্শও দিয়ে থাকি। বৃষ্টি বা ঝড়ের সময় বিদ্যুৎহীন গ্রাম্য সড়কে পিচ্ছিল রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে, কখনো নৌকায়, কলাগাছের ভেলায়, হ্যারিকেন হাতে রাত ২-৩টায় বাঞ্ছারামপুর ও পার্শ্ববর্তী হোমনা উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে সন্তান প্রসবে সাহায্য করেছি। এমনও হয়েছে যে, নদীতে গোসল করছি- খবর এলো অমুকের প্রসববেদনা শুরু হয়েছে, আমি গোসল না করেই বা রাতের খাবার প্লেটে রেখেই দে ছুট, ওই নারীর সন্তান যেন নিরাপদে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতে পারে, সে বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছি।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন নিশিত কুমার নন্দী টেলিফোনে জানান, ‘আমি অভিভূত আমার কর্মজীবনে আমার অধীন ফাতেমা বেগমের মতো একজন দক্ষ ধাত্রী পেয়ে। তার নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’

আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি কী? এমন প্রশ্নের জবাবে ফাতেমা বেগম বলেন, যখন আমি দেখি সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তার মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়ি কোনো ‘লিঙ্গ’ না দেখে তাকে পৃথিবীতে বরণ করে নিচ্ছেন। তখন খুব আনন্দ হয়। আর কষ্ট পাই যখন কোনো গর্ভবতী মা মৃত সন্তান প্রসব করে।

বাঞ্ছারামপুর সরকারি হাসপাতালের এই স্বাস্থ্য সহকারীকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেরা মাঠকর্মী হিসেবে তিনবার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বহু শিশুকে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে সহায়তা করেছেন। নিবেদিতপ্রাণ এই নারীর জন্য রইল শ্রদ্ধা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads