• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
কোরবানিতে চাহিদা বাড়ছে দেশীয় পশুর

সারা বছর গরুর মাংসের চাহিদা থাকলেও কোরবানির ঈদে বেড়ে যায় গরুর চাহিদা

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

কোরবানিতে চাহিদা বাড়ছে দেশীয় পশুর

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৮

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী জমে উঠেছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার। ঈদ অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে প্রতি বছর। এর কারণ মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়ছে। দেশে কোরবানির জন্য প্রবাসীরাও অর্থ পাঠান। যুক্ত হচ্ছে ঈদ বোনাস। সব মিলিয়ে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়া এবং এবার নির্বাচনের বছরে ঈদ হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি দুই হাজার কোটি টাকা যোগ হতে পারে বলে ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন। প্রতিবছরের মতো এবারো ব্যবসায়ীরা আশা করছেন সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদ অর্থনীতিতে আর্থিক লেনদেন পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সারা বছর গরুর মাংসের চাহিদা থাকলেও কোরবানির ঈদে বেড়ে যায় গরুর চাহিদা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু কোরবানির ঈদ উপলক্ষ করে কোরবানির পশু, পশুর চামড়াসহ অন্য খাতে কমবেশি ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর ৬০ শতাংশই হয় কোরবানির ঈদে। ঈদুল আজহায় কত সংখ্যক পশু কোরবানি হয়, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও বাণিজ্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশে কমবেশি ৪০ লাখ গরুসহ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ পশু কোরবানি হয়ে থাকে। আশার খবর হচ্ছে— ভারতীয় গরু আমদানিতে সীমান্তবর্তী রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩১টি করিডোরের ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৮ লাখ পরিবার সরাসরি গবাদিপশু পালনের সঙ্গে জড়িত। দেশে ৬০ শতাংশ গরু পালন করা হয় কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়।

চাহিদা মিটবে দেশি গরুতে

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী এবার ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী প্রস্তুত রয়েছে। অধিদফতরের বিবৃতি থেকে জানা যায়, কোরবানির জন্য পশুর মধ্যে ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭১ লাখ ছাগল-ভেড়া ও প্রায় ৩২ হাজার উট-দুম্বা প্রস্তুত রয়েছে। খামারে হূষ্টপুষ্ট হওয়া গরু-মহিষ প্রায় ২৯ লাখ ১০ হাজার। বাকি ১৫ লাখ ৪৬ হাজার অনুৎপাদনশীল বা বয়স্ক। এ বছর ছাগল-ভেড়ার মধ্যে হূষ্টপুষ্ট ১৮ লাখ ২৬ হাজার এবং অনুৎপাদনশীল ৫২ লাখ ৭৩ হাজার। দেশি গরুতেই ঈদুল আজহার কোরবানির চাহিদা মিটবে বলে আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বিবৃতি অনুযায়ী, গত বছর কোরবানির ঈদে দেশে ১ কোটি ৪ লাখ পশু জবাই হয়েছিল। তাই এ বছর এই হার ৫ শতাংশ বাড়লেও গরু-ছাগলের অভাব হবে না এমনটিই প্রত্যাশা তাদের।

আগ্রহ বাড়ছে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণে

এটি একটি আশাবাদের খবর। অন্যান্য বছর ট্যাবলেট খাইয়ে, ইনজেকশন পুশ করে যারা গবাদিপশু কোরবানির বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে মোটাতাজা করেছেন, তাদের মাছে অনেকেই এবার দেশীয় পদ্ধতিতে গবাদিপশু মোটাতাজা করেছেন কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য। কৃষক, গৃহস্থ ও খামারিরা কাঁচা ঘাস, ধানের খড়ের পাশাপাশি গরুকে খৈল, কুঁড়া, ভুসি খাওয়াচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন খামারির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত খবরে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিভিন্ন খবর বিশ্লেষণে দেখা গেছে. সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রচারণা, নির্দেশনা ও তদারকির ফলে খামারিদের মধ্যে এমন সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে দেখা গেছে, গত বছর যারা মোটাতাজাকরণের ট্যাবলেট খাইয়ে গরু নাদুসনুদুস করে হাটে তুলেও দাম পাননি, তারাই এবার দেশীয় পদ্ধতিতে গরু লালন-পালন করেছেন। খবরে প্রকাশ, কিছু খামারি অধিক লাভের লোভে কোরবানির ঈদের আগে গরুকে ইনজেকশন দিতেন অথবা বড়ি খাওয়াতেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে গরু ফুলে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত। কিন্তু গত বছর কোরবানির ঈদের হাটে নাদুসনুদুস গরুর প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই এবার কৃষক, গৃহস্থ ও খামারিরা ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ছেড়ে দেশি পদ্ধতিতে খৈল, কুঁড়া, ভুসি খাইয়ে গরু মোটাতাজা করেছেন।

সচেতন ক্রেতারা খামারমুখী

নিরাপদ পশুর জন্য বিশেষত ঢাকার ক্রেতারা পশু কিনতে খামারমুখী হচ্ছেন। হাটে মানুষের ভিড়ে পশু ঠিকমতো দেখা যায় না। দেখে-বুঝে কোরবানির পশু পছন্দ করার জন্যই আগ্রহীরা খামারের পরিবেশকে অনেক ভালো মনে করছেন। এ ছাড়া সেখানে নেই দালালদের দৌরাত্ম্য, প্রতারকদের খপ্পর। তা ছাড়া খামারে যখন-তখন পশু কেনা যায়। জেনে, শুনে, বুঝে নিরাপদ পশু কেনার জন্য অনেকে সরাসরি খামারে ছুটছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় আছে এমন বেশ কয়েকটি খামার।

বরাবরই দেখা যায়, কোরবানি নিয়ে সরকার ও জনসাধারণ চিন্তায় থাকেন। তখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের স্বরূপে আবির্ভূত হন। ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে গরু, মহিষ বাংলাদেশে পাচার করে। আমরা যখন পশুসম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই, তখন দেশীয় কৃষকদের সর্বস্বান্ত করার লক্ষ্যে অবাধে গরু, মহিষ পাচার করে দেশের খামারিদের উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করে। গরু নিয়ে দেশের সঙ্গে ভারতের এই গরুমি খেলা আমরা চাইলেই বন্ধ করতে পারি। আসুন কোরবানির জন্য আমরা সবাই দেশীয় গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলকে প্রাধান্য দিই। সহজাত হিসাবটি হলো, অধিক সংখ্যক দেশীয় গরু উৎপন্ন হলে দেশের মানুষ যেমন কম দামে গরুর মাংস পাবে, তেমনি পশুর বর্জ্য ও চামড়া রফতানি আয় বাড়বে। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও পশুর উচ্ছিষ্ট থেকে রফতানি আয় বাড়াতে দেশের স্বার্থে পশুসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই। প্রতিবেশী দেশ থেকে গরুবোঝাই ট্রাক আসুক কোনোভাবেই আমরা তা প্রত্যাশা করি না।

সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির হাটে ভ্যাটেরিনারি সেবাসংক্রান্ত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এসব তথ্য দেওয়া হয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ বছর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রতিটি ছোট পশুর হাটে অন্তত একটি, বড় হাটে দুটি এবং ঢাকার গাবতলী হাটে চারটি মেডিকেল টিম থাকবে। রাজধানীর প্রতিটি টিমে একজন ভ্যাটেরিনারি সার্জন, একজন টেকনিক্যাল কর্মী (ভিএফএ/ইউএলএ) এবং একজন করে শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্ন ভ্যাটেরিনারি সার্জন থাকবেন। গত বছর সারা দেশে ২ হাজার ৩৬২টি পশুর হাটে মোট ১ হাজার ১৯৩টি মেডিকেল টিম দায়িত্ব পালন করে।

গত বছরের মতো এ বছরও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর গবাদিপশুর খামারগুলোতে স্বাস্থ্যহানিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রাণী স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড, হরমোন জাতীয় ওষুধের বিক্রি ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বহাল থাকবে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকায় এসব দ্রব্য চোরাপথে আসা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে মনিটরিং এবং জেলা-উপজেলা প্রশাসনসহ পুলিশ প্রশাসন পল্লী চিকিৎসকদের মাধ্যমে এসব ব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নেবে।

একই সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি করা, ময়লা-বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলা, কোরবানির আগে ও পরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়ায় প্রচার চালানো হবে।

ব্রাহমা ও  মীরকাদিমের গরু

দেশে মাংসের সঙ্কট মেটাতে ২০১৪ সাল থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বিফ ব্রিড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় আমেরিকার ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় ব্রাহমা জাতের সিমেন দিয়ে ৩৩৪টি গাভীর প্রজনন শুরু হয়েছে। খামারিদের মধ্যে এই নতুন জাত নিয়ে সাড়া পড়েছে। আশা করা হচ্ছে, উৎপাদিত এ জাতের গাভী প্রতিদিন ১৮ কেজি দুধ দিতে সক্ষম। আর পূর্ণ বয়স্ক একটি ষাঁড় থেকে ১৫ মণ মাংস পাওয়া যাবে। দেশীয় জাতের গরু প্রতিদিনের দৈহিক ওজন ২০০-৩০০ গ্রাম বৃদ্ধি পায়। আর ব্রাহমা জাতের গরুর প্রতিদিনের দৈহিক ওজন ১ হাজার থেকে ১৫শ গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়। পূর্ণ বয়স্ক ষাঁড়ের ওজন ১৫ মণ হয়। আর গাভী প্রতিদিন ১৮ কেজি দুধ দেয়।

সাদা ধবল গরু আর ভুটানের বুট্টি গরুর জন্য খ্যাত মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল গরু বানাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষাঁড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। প্রতিটি গরু বড় করতে ও কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য উপযোগী করে তুলতে ৪ থেকে ৬ মাস সময় লাগে। ধান-চাল আর তেলের কারখানা থাকার কারণে মীরকাদিমের গরুকে মিনিকেট চালের খুদ, এক নাম্বার খৈল, ভাতের মাড়, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভুসি, গমের ভুসি, বুটের ভুসি খাওয়ানো হয়। এসব গরুর সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ গনিমিয়ার হাটে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা খাওয়ায় সুস্বাদু এই গরু কিনতে আসেন রহমতগঞ্জের গনিমিয়ার হাটে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads