• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

রামচাঁদ রায়

প্রথম বাংলা সচিত্র গ্রন্থের কথা

  • মাসুদুজ্জামান
  • প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০১৮

একটা ছবির কথা দিয়ে শুরু করি আজকের লেখাটি। তরুণ অ্যারিস্টটল। টেবিলের সামনে বসে পুঁথি পড়ছেন। তাঁর ডান হাতটি চেয়ারের হাতলে। বাঁ হাতটি টেবিলের ওপর ঠেকিয়ে ভাঁজ করে চিবুকে আলতো করে ছুঁয়ে পুঁথি পাঠ করছেন। গভীর সেই পাঠ। ছবি দেখেই সেটা বোঝা যায়। পড়ছেন সেকালের কোনো পুঁথি, একালের বই নয়। আমরা সবাই জানি বই যখন আসেনি তখন ছিল এই পুঁথি। এরপর আসে বই।

বই, বই আর বই। কত যে বর্ণ। কত যে গন্ধ। কত যে তার আকারপ্রকার। সাধারণ সাদামাটা বই থেকে এলো বহুবর্ণিল অলঙ্করণ সমৃদ্ধ বই। বাংলা বইয়ের ইতিহাসেও প্রথমে ছাপা হয়েছিল সাদামাটা বই, পরে এলো সচিত্র গ্রন্থ, অর্থাৎ চিত্রসমৃদ্ধ বই। এদেশে প্রথম বই কবে ছাপা হয়েছিল, আর প্রথম সচিত্র গ্রন্থই-বা কোনটি? আজকের লেখাটিতে আছে তারই সুলুকসন্ধান।

বইয়ের আবির্ভাব গুটেনবার্গের ছাপাখানার মাধ্যমে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। এরও প্রায় একশ’ বছর পরে ভারতবর্ষের গোয়ায় ছাপাখানা আসে। আকস্মিকভাবে। আবিসিনিয়ার সম্রাটের অনুরোধে জলপথে পর্তুগাল থেকে একটা ছাপাখানা আসছিল। তখন সুয়েজ খাল ছিল না। উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে জাহাজগুলোকে আবিসিনিয়ায় পৌঁছতে হতো। অনেক সময় পথে গোয়ায় জাহাজগুলো দুই-একদিনের জন্য থামত। এই জাহাজটিও সেভাবেই থেমেছিল। জাহাজে ছিলেন বেশ কয়েকজন জেসুইট পাদ্রী। পথিমধ্যে আবিসিনিয়ার সম্রাটের সঙ্গে তাদের মতান্তর ঘটে। জাহাজটি আবিসিনিয়ায় না গিয়ে গোয়াতেই নোঙর করল। মুদ্রণযন্ত্রটি এবং একজন স্পেনীয় মুদ্রাকর, হোয়াও দ্য বুসতামান্তে, গোয়াতেই থেকে গেলেন। এই ছাপাখানাতেই ১৫৫৬ সালে ভারতবর্ষে প্রকাশিত প্রথম বই, একটি পর্তুগিজ ধর্মগ্রন্থ, ছাপা হয়। গোয়ায় ছাপাখানা চালু হওয়ার ২২২ বছর পরে তা বাংলাদেশে আসে।

রাজ্য পরিচালনার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজদের দেশীয় ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল আর এর জন্য দরকার হলো বইয়ের। সংস্কৃতমনস্বী উইলিয়াম জোনসের প্রেরণায় ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড লিখলেন ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামক বইটি। ১৭৭৮ সালে এটি হুগলির জন অ্যান্ড্রুজের ছাপাখানায় ছাপা হলো। বইটির মুদ্রাকর ছিলেন ইংরেজ রাজকর্মচারী চার্লস উইলকিন্স্। উইলকিন্স্ই প্রথম তৈরি করলেন ছাপার উপযোগী বাংলা টাইপ, এক-একটা আলাদা অক্ষর, যাকে বলা হয় ‘বিচল হরফ’। তাঁর এই কাজে সহায়তা করেছিলেন একজন বাঙালি শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার। বাংলা সাহিত্য ও প্রকাশনায় খুলে গেল নতুন দিগন্ত। বিচল হরফ পর পর সাজিয়ে শুরু হলো বাংলা বই ছাপানো। ঢাকায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এরও অনেক পরে, ১৮৬০ সালে। পূর্ববঙ্গে শুরু হলো সাহিত্যচর্চার ধারা। আসলে ছাপাখানাকে কেন্দ্র করে কী ঘটেছিল সেদিন, সেটা এক চমকপ্রদ ইতিহাস।

বাংলা সাহিত্যের বয়স হাজার বছর বা তার কিছু বেশি। এদেশে প্রথমে তালপাতা, পরে কাগজ-কালিতে হাতে পুঁথি লেখা হতো। এখনকার বই সম্পর্কে তখন কারোরই ধারণা ছিল না। কিন্তু যারা পুঁথি রচনা করতেন আর সেগুলো যারা হাতে লিখতেন, এক-একটা পুঁথিকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলার দিকে তাদের বেশ নজর ছিল। আধুনিক কালে শৈল্পিক এই সৌকর্যকেই আমরা বলি অলঙ্করণ। কিন্তু পুঁথির কালে অলঙ্করণের দিকটি সেভাবে শৈল্পিক করে তোলা যায়নি। সচিত্র গ্রন্থেরও আবির্ভাব ঘটেছে চার দশক পরে।

একথা তো বলাই বাহুল্য যে, অলঙ্কারহীন একই ধরনের সাদামাটা বই পড়তে পড়তে পাঠকের চোখ ও মন পীড়িত বোধ করতে থাকে। বাক্যের পর বাক্য সার সার করে সাজানো, কোনো বৈচিত্র্য নেই, নেই চোখের আরাম। এরকম বই-ই হয়ে ওঠে যান্ত্রিক পাঠ। এই একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার প্রেরণাতেই সূত্রপাত ঘটলো গ্রন্থের অলঙ্করণ আর সাজসজ্জার। প্রকাশিত হলো প্রথম সচিত্র গ্রন্থ। বইটি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ১৮১৬ সালে কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির ছাপাখানা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। এটিই মূলত বাঙালি শিল্পীদের আঁকা ছবিতে সমৃদ্ধ প্রথম বাংলা বই। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যকে বইটির প্রকাশক বলে মনে করলেও সুকুমার সেন দ্বিমত পোষণ করেছেন। কারণ প্রকাশিত গ্রন্থের কোথাও গঙ্গাকিশোরের নাম নেই।

বইটিতে ছয়টি ছবি ছিল, কাঠখোদাই আর ধাতু খোদাইয়ের। দুটি এনগ্রেভিং চিত্রে লেখা ছিল ‘এনগ্রেভড বাই রামচাঁদ রায়’। এ দুটি ছবিই অশ্বারোহী সুন্দরের। সুকুমার সেন বলেছেন, ‘অপর ছবিগুলোতে অন্নাপূর্ণার মূর্তি ছাড়া সুন্দরের মূর্তি একটু অন্যরকম। সেগুলো রামচাঁদ রায়ের আঁকা বলে মনে হয় না।’  ওই ছবিগুলো কার আঁকা তার উল্লেখ নেই। রামচাঁদের দুটি ছবির সঙ্গে অন্য চারটি ছবির মিলও ছিল না। তাই ধারণা করা হয়, ওই ছবিগুলো অন্য কারো আঁকা। ছবিগুলোর নাম অন্নপূর্ণা, সুন্দরের বর্ধমানে যাত্রা, সুন্দরের বর্ধমানে প্রবেশ, সুন্দর ও দারোয়ান, বিদ্যাসুন্দর দর্শন ও সুন্দরের চোর ধরা। রামচাঁদ যে ইংরেজি জানা দক্ষ কারিগর ছিলেন, তা তাঁর স্বাক্ষর থেকে বোঝা যায়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে রামচাঁদ রায়ই হচ্ছেন বাংলা গ্রন্থচিত্রণ শিল্পের আদিপুরুষ। এখনকার ভাষায় তিনিই প্রথম বাংলা সচিত্র গ্রন্থের ইলাস্ট্রেশন করেন।

সচিত্র অন্নদামঙ্গল গ্রন্থটি প্রকাশের ঠিক দু-বছর পর, অর্থাৎ ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সচিত্র বাংলা গ্রন্থ। বইটির নাম ‘সঙ্গীততরঙ্গ’। রাধামোহন দাস রচিত এই গ্রন্থে রামচাঁদ রায়ের আঁকা ছটি ছবি দেখতে পাই। ছটি ছবিই ছিল ধাতুখোদাই ছবি। এই দুটি বইয়ের পাশাপাশি ওই সময় আরো কিছু সচিত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেমন আনন্দলহরী, গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিণী, গৌরীবিলাস, বত্রিশ সিংহাসন ইত্যাদি। শিল্পীরা ছিলেন রূপচাঁদ রায়, মাধব দাস, রামধন স্বর্ণকার, বিশ্বম্ভর আচার্য, বীরচন্দ্র দত্ত, রামসাগর চক্রবর্তী প্রমুখ। সবাইকে ছাপিয়ে এই সচিত্রকরণের ইতিহাসে পঞ্চানন কর্মকারের কাছে আমরা বিশেষভাবে ঋণী। তিনি বিচল হরফের নির্মাতা শুধু নন, ছিলেন চিত্রকরও। কাঠখোদাইতে ছিলেন দক্ষ। সেই সঙ্গে অক্ষর-নির্মাণ, ঢালাই, খোদাই করা এবং মুদ্রণশিল্পের নানান কৌশল তিনি বিদেশিদের কাছ থেকে শিখেছিলেন, যা আমাদের প্রকাশনার আদি ইতিহাস হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

আজ বইয়ের অঙ্গসজ্জা, ইলাস্ট্রেশন বা অলঙ্করণের দিকগুলো অনেক সহজ হয়ে গেছে। ডিজিটাল যুগে পৌঁছেছি আমরা। এই যুগে প্রযুক্তিই আমাদের বইয়ের অঙ্গসজ্জা আর অলঙ্করণের কাজগুলো নিখুঁত আর সুন্দর করে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কি কখনো বাংলা বিচল হরফের স্রষ্টা উলকিন্স্, পঞ্চানন কর্মকার আর চিত্রণশিল্পী রামচাঁদ রায়ের কথা ভুলতে পারব? প্রত্যুত্তরে বলব, কখনো নয়, তাঁরা তো আমাদের প্রকাশনা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads