• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
জাতিসংঘে একদিন!

বিশেষ করে বাল্যবিয়ের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

জাতিসংঘে একদিন!

  • প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০১৮

সম্প্রতি জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরামে (এইচএলপিএফ) অংশ নিয়েছেন নাইমুল ইসলাম। টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা ২০৩০ এবং এর লক্ষ্যসমূহের (এসডিজিস) বৈশ্বিক পর্যালোচনা ও পরবর্তী নীতিনির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে এইচএলপিএফ মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে এই উচ্চপর্যায়ের ফোরামে বাংলাদেশ মডেল ইয়ুথ পার্লামেন্টের হয়ে বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। জাতিসংঘে তার সেই অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরলেন তিনি-

নাইমুল ইসলাম

দিনপঞ্জির পাতায় জুলাই মাসের ১০ তারিখ। সকাল থেকেই মনের মধ্যে কাজ করছিল অন্যরকম অনুভূতি। বড় উঁচু কাচের দালান আর তার সামনে পতপত করে উড়ছে প্রতিটি দেশের পতাকা। ছোটবেলা থেকেই এমন দৃশ্য দেখতাম টেলিভিশনের পর্দায়। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। বলছিলাম নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদর দফতরের কথা। বহুদিনের একটা ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে আজ। এমন স্মরণীয় দিন রোজ রোজ আসে না। জাতিসংঘের হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরামে (এইচএলপিএফ) অংশ নিয়ে বহুদিনের লালায়িত স্বপ্ন পরিণত হলো বাস্তবে। এইচএলপিএফ হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে জাতিসংঘের মূল প্লাটফর্ম। টেকসই উন্নয়ন অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য জাতিসংঘের হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরাম (এইচএলপিএফ) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয় ২০১২ সালে। টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা ২০৩০ এবং এর লক্ষ্যসমূহের (এসডিজিস) বৈশ্বিক পর্যালোচনা ও পরবর্তী নীতিনির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে এইচএলপিএফ মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে আট দিনব্যাপী এই উচ্চপর্যায়ের ফোরামে বাংলাদেশ মডেল ইয়ুথ পার্লামেন্টের হয়ে বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। এবার আসি প্রথম দিনের কথায়। আগে থেকে অবস্থান করছিলাম নিউইয়র্কে। বাংলাদেশ মডেল ইয়ুথ পার্লামেন্টের নির্বাহী প্রধান সোহানুর রহমান হঠাৎ জানালেন আমাকে জাতিসংঘ সদর দফতরে হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরামে বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সংবাদটি শুনে আনন্দে শিহরিত হচ্ছিলাম। আগের রাতে হাতে পেলাম সদর দফতরে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষিত গ্রাউন্ড পাস। পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় নিজেকে যতটুকু পারি প্রস্তুত করলাম। সকালবেলা যখন সব নিরাপত্ত বেষ্টনী পেরিয়ে প্রধান ফটক দিয়ে জাতিসংঘ ভবনে প্রবেশ করছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল আমিই যেন বাংলাদেশ! ১০ জুলাই দিনব্যাপী ছিল বেশ কয়েকটি ইভেন্ট। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মূল ভবনের পাশে চার্চ সেন্টারে এসডিজি নিরীক্ষণ এবং অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য নাগরিক সমাজের কৌশল এবং সরঞ্জামের ওপর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই-কমিশনারের অফিসের সঙ্গে কর্মশালার আয়োজন করে নাগরিক সমাজের আন্তর্জাতিক জোট সিভিকাস, অ্যাকশন ফর সাসটেইন্যাবল ডেভেলপমেন্ট এবং সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রাইটস। সঞ্চালক হিসেবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই-কমিশনারের প্রতিনিধি স্যালি এনের বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হয় কার্যক্রম। তিনটি সেশনে ভাগ করে কর্মশালায় মানবাধিকার প্রতিবেদন, বিভিন্ন দেশের সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন এবং এসডিজি অর্জনে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে নাগরিক সমাজের কর্তব্য নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়। সেশনে ছিল প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা পর্ব। উন্নত দেশের প্রতিনিধিরা তাদের অবস্থান তুলে ধরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর তাগিদ দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিপীড়িত শরণার্থী রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় প্রদান করেছেন উল্লেখ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলেও আমরা তা করতে পেরেছি। রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনসহ মানবাধিকার নিশ্চিত করতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরি এবং সেক্ষেত্রে কীভাবে সরকার-নাগরিক সমাজের মধ্যে সমন্বয় করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় সে সম্পর্কে নিজের মতামত তুলে ধরি। অনুষ্ঠান শেষে পরিচিত হই বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের সঙ্গে, আলোচনা হয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। দুপুরের খাবার শেষে দেড়টা থেকে ৩টা পর্যন্ত জাতিসংঘ প্রধান ভবনের কনফারেন্স হলে বনাঞ্চল ও পানি এবং জলজ সম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সাইড ইভেন্ট। মেরিন বায়োলজির ছাত্র এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় এ ইভেন্টে আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করি। এত বন এবং জলের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহনশীল সমাজ তৈরিতে করণীয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। তুলে ধরা হয় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও। এটি আয়োজন করেন জাতিসংঘে অস্ট্রিয়ার স্থায়ী মিশন, ইন্টারন্যাশনাল ফরেস্ট রিসার্চ ইউনিয়ন এবং ব্রাজিল ও ফিনল্যান্ডের সরকারি প্রতিনিধি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে অস্ট্রিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ফিলিপ চার্লাথ, জাতিসংঘের সিনিয়র ফরেস্ট পলিসি অফিসার ড. হোসেন, ইন্টারন্যাশনাল ফরেস্ট রিসার্চ ইউনিয়নের এক্সপার্ট ড. ক্রিসটপ। প্রফেসর ড. মেইন এবং ড. ইরেনা মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তা ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ফরেস্ট রিসার্চ ইউনিয়ন ওই বিষয়ের ওপর একটি পলিসি ব্রিফ বের করে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের অধীনে বসা এইচএলপিএফ বৈঠকের আট দিনের মহাযজ্ঞে সব মিলিয়ে আটটি স্পেশাল মিটিং, ২৫টি বিষয়ভিত্তিক মিটিং, ২৬০টি সাইড ইভেন্ট, ৩৩টি এক্সিবিশনসহ বিভিন্ন ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও বেশ কয়েকটি সাইড ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। জাতিসংঘ সদর দফতর সংলগ্ন মিলেনিয়াম হিলটন হোটেলে অনুষ্ঠিত এক ইভেন্টে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মূল বক্তা হিসেবে এলডিসিভুক্ত হওয়ার পর থেকে আজকের অবস্থানে আসতে কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সেই সাফল্যের গল্প তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সাফল্যের কাহিনীই শুধু তুলে ধরা হয়নি; এগিয়ে চলা বাংলাদেশ ২০২১ সালে দেখতে কেমন হবে, তাদের কার্যক্রম থেকে তা এখনই স্পষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘসহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা। আলোচনায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনসহ অন্যান্য কূটনীতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। ব্যস্ততার কারণে পরবর্তী প্রোগ্রামগুলোতে সরাসরি উপস্থিত না থাকলেও বিশেষ সুবিধায় ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে মতামত প্রদান করার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরাম ছিল আমার জন্য বিশেষ কিছু। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা, নিজের মতপ্রকাশ করা, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে একটি বিরাট পাওয়া। স্বপ্ন ছিল একদিন জাতিসংঘের সদর দফতরে নিজের কথা বলব। সে স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে বাংলাদেশ মডেল ইয়ুথ পার্লামেন্টের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার ফলে। জাতিসংঘে দেশের তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম তা জীবনব্যাপী কখনো ভোলার নয়। প্রতিটি অধিবেশনে পুরো পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরা ও জোরালো কণ্ঠে এ দেশের তরুণদের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে পারা ছিল অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আসলে বাংলাদেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে বাল্যবিয়ের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়ার মতো নানা ইস্যুতে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি। তবে সম্ভাবনার দিক হলো, বাংলাদেশের মোট জনশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ জনসংখ্যার বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) চলছে। এ শক্তিকে জনসম্পদে রূপ দিতে হলে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ দরকার। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এসব বাধাকে ডিঙিয়ে অবহেলিত যুবকদের ভাগ্য ও জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখি। ভবিষ্যতে এসব পিছিয়ে পড়া তরুণদের হাত ধরেই স্বনির্ভর সাম্যভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে কাজ করতে চাই নিরন্তর।  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads