• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
মুক্তিযুদ্ধ ক্রীড়া সংস্কৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ মাগুরা

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সরিষাক্ষেতের মোহনীয় দৃশ্য

ছবি : করবি দে

ফিচার

মুক্তিযুদ্ধ ক্রীড়া সংস্কৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ মাগুরা

  • খান শরাফত হোসেন, মাগুরা
  • প্রকাশিত ২৮ আগস্ট ২০১৮

ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা সামনে রেখে মোগল শাসনামল হয়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামল পার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাগুরা জেলা। এ জেলায় রয়েছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস। রয়েছে জমিদার ও নীলকর সাহেবদের নীলচাষের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এবং মাগুরা জেলার মানুষ মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার আন্দোলন করে যেমন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও এ জেলার মানুষ পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মাগুরায় ছিলেন অসংখ্য আধ্যাত্মিক সাধক, ফকির, দরবেশ ও ধর্মপ্রচারক। আছে মুসলিম শাসনামলের স্থাপত্য মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা। শিল্পী-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ক্রীড়াবিদ সবক্ষেত্রেই রয়েছে মাগুরা জেলার সুনাম। সাহিত্য ও চিত্রকলা চর্চায় এ জেলা অন্য যে কোনো জেলার থেকে পিছিয়ে নেই। জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আজো সংস্কৃতির চর্চার চলছে। মাগুরা জেলায় কমপক্ষে ৩০টি সংস্কৃতিচর্চা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান শিশু-কিশোর বয়স থেকেই নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক ও আর্ট শিখিয়ে আসছে। শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গন কেন, এ জেলায় রয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের ঐতিহ্য। বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ স্থান দখল করে সুনাম বয়ে আনছে মাগুরার ক্রীড়াবিদরা। বাংলাদেশে প্রচলিত সব খেলায় জাতীয় দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রীড়াবিদ মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন।

১৪০ বছর মাগুরা ছিল যশোর জেলার অধীন একটি মহকুমা। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মাগুরা জেলার শিক্ষার হার ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ। মাগুরা জেলার টুপিপাড়া গ্রামের মরহুম গোলাম কাদেরের ছেলে মো. আকবর হোসেন মিয়া ১৯৫১ সালে পাক বিমানবাহিনীতে চাকরি নেন। ১৯৫৪ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন সামাজিক কাজে। নিজ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আকবর হোসেন মিয়া গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী বাহিনী। তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এই বাহিনীর বীরোচিত তৎপরতার স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শাখা বাহিনী হিসেবে শ্রীপুর বাহিনী নামে অনুমোদন দিয়ে সনদপত্র প্রেরণ করেন। এ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আকবর হোসেন মিয়া। বীরপ্রতীক গোলাম ইয়াকুব জন্মগ্রহণ করেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নারানদিয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গোলাম ইয়াকুবকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

এছাড়া সঙ্গীতের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা পুরুষ মরহুম ওস্তাদ মুনশী রইচউদ্দিন, সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভন, 

রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ, ডা. লুৎফর রহমান, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদ মিরাজ উদ্দীন হোসেনসহ হজরত পীর গরীব শাহ দেওয়ানের মতো বহু ব্যক্তিত্বের জন্ম মাগুরাতে।

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জনপদ মাগুরার ভৌগোলিক অবস্থান ২৩-২৯ দশমিক উত্তর অক্ষাংশে ৮১ দশমিক ২৬ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। মাগুরার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ।

মাগুরার নামকরণ : মাগুরা প্রাচীন আমলের একটি গ্রাম। কখন থেকে মাগুরা নামকরণ করা হয়েছে, তার সঠিক হিসাব মেলানো খুবই কষ্টসাধ্য। মাগুরা দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। মহকুমা সদরের আগে মাগুরা এবং পশ্চিমাংশে দরিমাগুরা। দরি শব্দের আভিধানিক অর্থ মাদুর। এখানে মাদুর তৈরির সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত বলেই নাম হয়েছে দরিমাগুরা।

ঐতিহাসিক হান্টার তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন বৃহত্তর যশোরে এককালে ৩৬টি নদী ছিল। (তথ্যসূত্র : যশোর খুলনার ইতিহাস নামক গ্রন্থ) মাগুরা নামকরণের ক্ষেত্রে নদী বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। মাগুরার বুক চিরে এককালে প্রবল প্রতাপে প্রবাহিত ছিল আজকের মরা নদী নবগঙ্গা। খরস্রোতা এই নদীর ভয়াল দৃশ্য দেখেই সেকালের লোকেরা নাম রেখেছিল নবগঙ্গা। গঙ্গা নদীর সঙ্গে ছিল তার মিল। নদীপথে মগরা মাগুরা এলাকায় এসে আস্তানা গড়ে তোলে।

এ সময় ধর্মদাস নামে এক ব্যক্তি (মগ দস্যু) আরাকান থেকে এসে আজকের মাগুরা শহরের উত্তর-পূর্ব কোণে গড়াই নদীর তীরে খালুম বাড়ী মৌজা দখল করে নেয়। লোকে তাকে মগ জায়গীর বলে আখ্যায়িত করেছিল। জিন্দাপীর আওরঙ্গজেবের আমলে ধর্মদাস উপায়ান্তর না পেয়ে জীবন নাশের ভয়ে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। পরে তার নাম হয় নিজাম শাহ। মগ জলদস্যুরা এদেশে এসে সুন্দরী মেয়েদের নির্যাতন শুরু করে। তারা ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে লুটতরাজ চালায়।

নিরীহ জনগণ মগদস্যুদের অত্যাচারে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে। জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে এ অঞ্চল।  অনেকের মতে, মগ শব্দ থেকেই মাগুরা নামের উৎপত্তি। ১৮৪৫ সালে মাগুরা মহকুমা করার উদ্দেশ্য ছিল এলাকার অপরাধ দমন করা। লোকমুখে শোনা যায় মাগুরা এলাকায় ছিল বড় বড় বিল। সেই বিলে পাওয়া যেত প্রচুর মাগুর মাছ। এই মাগুর মাছের নাম থেকেও মাগুরা নামের উৎপত্তি হতে পারে।

মাগুরা নামের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছে মতভেদ। এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সত্যের দিকে এগিয়ে গেলে বোঝা যাবে মগ থেকেই মাগুরা নামের উৎপত্তির সম্ভাবনা অধিক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads