• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
প্রশ্নোত্তরে উচ্চ রক্তচাপ

এই নীরব ঘাতক নিয়ে অনেকেই অজ্ঞতাজনিত ভয়ে থাকেন

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

প্রশ্নোত্তরে উচ্চ রক্তচাপ

  • প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০১৮

ডা. রাণা হাসান

আমাদের হৃৎপিণ্ড শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত পৌঁছে দেয় পর্যায়ক্রমে সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে। সংকোচন ও প্রসারণের সময়, রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচলের সময় রক্তনালির দেয়ালের ওপর এক ধরনের চাপ দেয়। একে আমরা রক্তচাপ বলি। রক্তচাপ দুই ধরনের : উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার) ও নিম্ন রক্তচাপ (লো ব্লাড প্রেসার)। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন নিয়ে আমাদের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। উচ্চ রক্তচাপ সাধারণ্যে ‘প্রেসার’ নামে খ্যাত বা কুখ্যাত। এই নীরব ঘাতক নিয়ে অনেকেই অজ্ঞতাজনিত ভয়ে থাকেন। এই অহেতুক ভয় থেকেই আমাদের দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব অধিকাংশের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে।

# রক্তচাপ মাপক যন্ত্রে রক্তচাপ অস্বাভাবিক আছে কিন্তু কোনো উপসর্গ যেমন মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা বা মাথা ঘোরা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, ঘাম, ঘুমের সমস্যা, খারাপ লাগা নেই, আর যেহেতু এগুলোই উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ, তাহলে উচ্চ রক্তচাপ হবে কেন?

- অধিকাংশ মানুষই এমন সময় ওষুধ সেবন করেন না। বেশিরভাগ সময়েই উচ্চ রক্তচাপের কোনো উপসর্গ বা লক্ষণই প্রকাশ পায় না। এর ফলে এমনকি অনেকে জানেনই না তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। অন্যান্য রোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর রক্তচাপের পরীক্ষা করার সময় হয়তো বিষয়টি ধরা পড়ে। তাই লক্ষণ না থাকলেও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

# চল্লিশের আগে রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হয় না?

- যুক্তরাষ্ট্রের প্রিভেনটিভ সার্ভিস টাস্কফোর্সের মত অনুসারে, ১৮ বছর থেকেই উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হয়।

একটু বয়স হলে রক্তচাপ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক- একথা মনে করে অনেকেই ওষুধ সেবন করেন না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, বয়স বাড়লেই হূদরোগ, স্ট্রোক বা কিডনি রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বয়স বাড়তে থাকলেই রক্তচাপ, রক্তের শর্করা বা রক্তের চর্বি নিয়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।

# কেবল পুরুষেরই উচ্চ রক্তচাপ হয়?

- কেবল পুরুষেরই নয়, নারীদেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যাদের স্থূলতার সমস্যা রয়েছে, যারা জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ খেয়ে থাকেন, যারা গর্ভবতী, যাদের বংশগত  উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস রয়েছে বা মাসিক বন্ধ হয়েছে, তাদের এই সমস্যা হতে পারে।

#  একবার উচ্চ রক্তচাপ বেশি পাওয়া মানেই উচ্চ রক্তচাপের  রোগী? 

- মোটেই না। পরপর তিন দিন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় যদি কারো রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়, তবেই ধরে নিতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। নানা কারণে হঠাৎ একটু আধটু রক্তচাপ বাড়তে পারে। তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগী বলতে হলে সংশ্লিষ্টজনের রক্তচাপ পরপর তিন দিন মাপতে হবে।

#  রক্তচাপের ক্ষেত্রে উপরের মাত্রা বেশি থাকলে সমস্যা হয় না; কিন্তু নিচের মাত্রা বেশি হলেই ওষুধ খেতে হয়?

- রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র আমাদের দুটি মাত্রা প্রদর্শন করে- সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক। প্রতিবার-

#  হূদস্পন্দনের সঙ্গে রক্ত রক্তনালিতে যে চাপ প্রয়োগ করে, তা হলো সিস্টোলিক রক্তচাপ। আর দুটি হূদস্পন্দনের মাঝে বিশ্রামের সময় রক্তনালির ওপর যে চাপ তৈরি হয়, তা হলো ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ। সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক দুটিতেই অস্বাভাবিক মাত্রা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই দুটি বিষয়ই  সমান গুরুত্বপূর্ণ। 

#  কাঁচা লবণ খেলে ‘প্রেসার’ বাড়ে, তাই লবণ ভেজে খাওয়া ভালো?

- এটাও একেবারেই ভুল কথা। ভাতের পাতে আলগা লবণ একেবারেই বাদ দিতে হবে। পরিমাণের তুলনায় অতিরিক্ত লবণ ভেজে খাওয়া আর তরকারিতে খাওয়া একই কথা। খেয়াল রাখতে হবে প্রতিদিন গৃহীত লবণের পরিমাণ যেন ৬ গ্রাম বা পূর্ণ এক চামচের বেশি না হয়। সে জন্যই প্যাকেটজাত খাবার, সস, মেয়োনেজ, প্যাকেটজাত স্যুপ, আচার, চানাচুর ইত্যাদি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া ভালো।

#  কোলেস্টেরল বেশি থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হয়।

- আসলে রক্তচাপের সঙ্গে ডিম, দুধের কোনো সম্পর্ক নেই। ডিমের কুসুম, পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ, ননিযুক্ত পনির, মাখন ইত্যাদি রক্তে চর্বি বা কোলেস্টেরল বাড়ায় বলে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের হূদযন্ত্রের ঝুঁকি কমাতে এসব কিছু খাবার খেতে নিষেধ করা হয়ে থাকে। ডিমের সাদা অংশ কিংবা সরবিহীন দুধ রোজই খাওয়া যাবে।

# ঘাড় ব্যথা মানেই প্রেসার?

- কখনোই না। নানা কারণে ঘাড় ব্যথা হয়। খুবই কম ক্ষেত্রে প্রেসারের আধিক্যে ঘাড় ব্যথা হয়।

# উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ একবার খেলে সারা জীবন খেতে হবে?

- এ ভুল ধারণা থেকে অনেকে তাই ওষুধ খেতে চান না। এটা ঠিক নয়। কারণ শরীর নিজে নিজে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে অবশ্যই ওষুধের সাহায্য নিতে হবে। কেননা চিকিৎসায় অযথা দেরি বাড়তি রক্তচাপ শারীরিক ক্ষতি করতে মোটেও দেরি করবে না।

# ‘প্রেসার’ কমে গেলে ওষুধ ছেড়ে দেওয়ায় কোনো ক্ষতি নেই?

- এটাও সংশ্লিষ্টজনের জন্য মারাত্মক সিদ্ধান্ত। মনে রাখতে হবে, ওষুধ খাওয়ার ফলেই ‘প্রেসার’ নিয়ন্ত্রণে আছে। তাই ওষুধ ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপজনিত শারীরিক জটিলতার হুমকিকে ত্বরান্বিত করা।

# অন্যান্য ‘প্রেসারের’ রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ খেলে কোনো সমস্যা নেই?

- যে ওষুধ খেয়ে একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, তা অন্যদের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে এমন কোনো কথা নেই। উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে আনুষঙ্গিকভাবে হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হূদরোগ বা অন্য কোনো রোগ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ওষুধও বদলে যাবে। তাই অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ জীবনাচরণের ওপরও অনেকটাই নির্ভরশীল। তাই বাড়তি ওজন কমিয়ে,  লবণ, অ্যালকোহল ও ধূমপান পরিহার করে, সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলে, নিয়মিত শরীরচর্চা করে, পরিমিত ঘুমের অভ্যাস করে, সবধরনের মানসিক চাপ কমিয়ে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করে জীবনকে উচ্চ রক্তচাপের ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads