• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
ধর্ষণ মামলা : সুবিচার কম ভোগান্তি বেশি

মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেকেই ধর্ষণের ঘটনা চেপে যায়

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

ধর্ষণ মামলা : সুবিচার কম ভোগান্তি বেশি

  • মনিরা তাবাস্সুম
  • প্রকাশিত ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিগত কয়েক বছরে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ, ভয়াবহভাবে বেড়েছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। বিভিন্ন বয়সী নারী থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত শিকার হচ্ছে এমন ভয়াবহ ঘটনার। কিন্তু নির্যাতিত এসব নারী ও শিশুকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। থানায় অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে মামলা চলাকালীন প্রতিটি পদে হয়রানির শিকার হতে হয় ধর্ষণের শিকার নারীটিকে। সামাজিক নানা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত নানা ভয়ভীতি এবং হুমকির কারণে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে পরিবারটির জীবন। এসব কারণে এবং সামাজিকভাবে হেয় হওয়া ও লোকলজ্জার ভয়ে অধিকাংশ পরিবারই আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। অনেকেই আবার আইনের আশ্রয় না নিয়ে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি মেটাতে চান। কোনো কোনো পরিবার সম্মানহানির ভয়ে ও মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ধর্ষণের মতো ঘটনাটিকেও চেপে যায়। আর সব বাধা পেরিয়ে যেসব অভিযোগ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে, তার বেশিরভাগই নানা কারণে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। হাতে গোনা কিছু মামলা হয়তবা আলোর মুখ দেখে অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে।

আর এসবের অধিকাংশ কারণই হলো প্রতিটি পদে মেয়েটিকে আপত্তিকর নানা প্রশ্ন এবং সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হতে হয়। বার বার একই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বার বার। আদালতপাড়ায় ন্যায়বিচারের আশায় আসা এমন এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ বছরের মেয়েটি তারই এক আত্মীয়ের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু ঘটনার কয়েক দিন পর সেটি সে তার পরিবারকে জানায়। পরিবার মামলা করতে গেলে কোনো মেডিকেল রিপোর্ট দেখাতে না পারার কারণে মামলা করা এবং বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এই পরিবারটির মতো এমন অনেকেই আরো কিছু ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকে।

আদালতে প্রতিপক্ষের আইনজীবীর বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর প্রশ্নের সামনে বার বার নিজের চারিত্রের স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে হয়। মেডিকেল রিপোর্ট বদলে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। সেক্ষেত্রে মেয়েটির ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা আরো ক্ষীণ হয়ে আসে। এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনার জন্য সমাজ সবসময় মেয়েটিকেই দায়ী করে থাকে।   

সারা দেশে আটটি ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার মেয়েদের কাউন্সেলিং, পুলিশি ও আইনি সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলোতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা সহায়তা নিতে এসেছেন ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী। এসব ঘটনার মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৩টি ঘটনায়, যেগুলোর মধ্যে ৮০২টি ঘটনার বিচার শেষে রায় দেওয়া হয়েছে। আর এসব রায়ের প্রেক্ষিতে শাস্তি পেয়েছে ১০১ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি। এতে দেখা যায়, রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ এবং সাজাপ্রাপ্তির হার ০ দশমিক ৪৫ ভাগ। এ পরিসংক্ষান খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয় ভুক্তভোগী নারীরা কতখানি ন্যায়বিচার পান।

এ ছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, চার বছরে দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ সংক্রান্ত ১৭ হাজার ২৮৯টি মামলা দায়ের হয়েছে, যাতে মোট ভিকটিমের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৯ জন। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬১ জন নারী এবং শিশু ৩ হাজার ৫২৮। এসব মামলার মধ্যে ৩ হাজার ৪৩০টি ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোতে ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৮০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫৭৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ মোট ৬৭৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) বার্ষিক শিশু অধিকার পরিস্থিতি-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১২ শিশু।

বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ হাজার ৮০০’র বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, ধর্ষণ মামলায় আইনের ফাঁকফোকর, মামলার ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং অজ্ঞানতার কারণে  বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক বিচার পান না ভুক্তভোগীরা। যদিও আইনে আছে ধর্ষণ মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। মামলা দায়ের করার পর থেকে সেই মামলা নিষ্পত্তি হতে লেগে যায় বছরের পর বছর। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে দেখা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। পুলিশি তদন্তে ত্রুটি এবং অবহেলা ছাড়াও এর পেছনে কাজ করছে নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি বা পরিবারটিকে প্রভাব বা ভয় দেখিয়ে সালিশের মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানা বা অভিযুক্ত ব্যক্তিটির সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে ঘটনা মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। এমন হাজারো ঘটনা আছে যা প্রকাশ পায় না বা প্রকাশ পেলেও মামলা আদালতে যায় না। ফলে অপরাধীরা বার বার অপরাধ করার সুযোগ পায়।

ধর্ষণ মামলায় নারীর ভোগান্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেন, একটি মেয়ে সুবিচার পাওয়ার আশা নিয়ে বিচার চাইতে আসে। কিন্তু প্রথমেই তাকে হোঁচট খেতে হয় মেডিকেল টেস্ট করাতে গিয়ে। যখনই কেউ শোনে এমন একটি ঘটনার শিকার সে, সেক্ষেত্রে সবাই একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকায়। দ্বিতীয়ত, মেয়েটি ঘটনার পর থেকে পদে পদে একই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয় বার বার। এক্ষেত্রে বার বার ধর্ষণের বিবরণ ও প্রমাণ উপস্থাপন করতে গিয়ে সে অনেকটাই ট্রমাটাইজ হয়ে যায়। এ ছাড়া যেসব শেল্টারহোমে মেয়েগুলোকে রাখা হয়, সেখানকার পরিবেশটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তাকে যে ধরনের ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখা দরকার, তা সে পাচ্ছে কি-না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এরপর যখন আদালতে মামলাটি যায়, সেটিও নানা কারণে অনেক সময় নষ্ট হয়। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে বলে একটা সময়ে বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশা দেখা দেয়। আর এর মাঝে সুযোগ এলেও মেয়েটি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে না।

এই বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। আলোচিত ঘটনাগুলো ও সঠিক তথ্য প্রমাণের অভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর যে ঘটনাগুলো কোনো গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায় না এমন অনেক ঘটনার ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুরা সামাজিকভাবে একঘরে হওয়ার ভয়ে লাঞ্ছনা সহ্য করেই দিনাতিপাত করে। এসব নারীর সুবিচার পাইয়ে দিতে আরো কঠোর আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করে সুশীল সমাজ।

হাইকোর্ট প্রদত্ত ১৮টি নীতিমালা

১. ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের অভিযোগের ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে (ডিউটি অফিসার) দ্রুত লিখিত অভিযোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানার আওতায় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে কি-না, তা বিবেচনা করতে গিয়ে কোনো রকম বৈষম্য বা বিলম্ব করা চলবে না।

২. অবিলম্বে এ-সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইট খুলতে হবে, যেখানে অভিযোগকারী তার অভিযোগ বা তথ্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন।

৩. কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিলম্ব বা অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না।

৪. কনস্টেবলের নিচে নয় এমন একজন নারী পুলিশ প্রত্যেক থানায় ২৪ ঘণ্টা রাখতে হবে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের তথ্য নেওয়ার কাজটি করবেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। আর তা করতে হবে ভুক্তভোগী, ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য অথবা ভুক্তভোগীর পছন্দমতো কারো উপস্থিতিতে।

৫. সব পর্যায়ের ভুক্তভোগীর পরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

৬. প্রত্যেক থানা নারী সমাজকর্মীদের একটি তালিকা তৈরি করবে; যারা সংশ্লিষ্ট থানাকে সহযোগিতা করবেন।

৭. নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সমাজকর্মী, আইনজীবী অথবা ভুক্তভোগীর মনোনীত কারো উপস্থিতিতে ভুক্তভোগীর জবানবন্দি গ্রহণ কতে হবে।

৮. একজন ভুক্তভোগী হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে কী অধিকার আছে সে বিষয়ে ভুক্তভোগীকে সচেতন করতে হবে এবং সে অনুরোধ জানালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে কোনো তথ্য তাকে দিতে হবে।

৯. তথ্য পাওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্তব্যরত কর্মকর্তা বিষয়টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারকে অবহিত করবেন।

১০. বুঝতে অক্ষম এমন ভুক্তভোগী নারী, শিশু বা তরুণীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ‘করণিক সেবা’ দিতে হবে।

১১. লিখিত তথ্য গ্রহণের পর বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা থানায় উপস্থিত একজন নারী পুলিশের সঙ্গে ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন।

১২. ভুক্তভোগীকে দ্রুত সারিয়ে তোলার জন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। 

১৩. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক সব মামলায় বাধ্যতামূলকভাবে রাসায়নিক বা ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে।

১৪. কথিত অপরাধ সংঘটনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাব বা ডিএনএ প্রোফাইলিং সেন্টারে পাঠাতে হবে।

১৫. তথ্য সংগ্রহে বা ভুক্তভোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।

১৬. যত দ্রুত সম্ভব তদন্তকাজ শেষ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

১৭. নারী, মেয়ে বা শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ১০৯২২-এর মতো জরুরি নম্বর বাড়িয়ে গণমাধ্যমে তার সচিত্র প্রচার চালাতে হবে।

১৮. ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও পরামর্শের জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে বলে হাইকোর্ট নির্দেশ প্রদান করেন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads