• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
আমরা যারা অভিভাবক

সন্তানরা চায় পিতা-মাতা হোক বন্ধু এবং ভরসার স্থল

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

খোলা চিঠি

আমরা যারা অভিভাবক

  • প্রকাশিত ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সময় নামক পাগলা ঘোড়ার পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছি আমরা। সময় নেই এমন অজুহাতে সন্তানের সঙ্গ ছাড়ছি। বিত্ত অর্জনের অসম প্রতিযোগিতায় জীবনকে সাজাতে গিয়ে জীবনেই বয়ে আনছি বেদনাবিধুর দুঃসময়ের হাতছানি। বাবা-মা অভিভাবকরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বোধহীন মানুষের মতো অর্থ আর প্রতিপত্তির পেছনে ছুটছি। গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি কি আমরা? ভাবছি না সামাজিক অবক্ষয় কোথায় নিয়ে ঠেকাবে আমাদের? ভাবছি না সমাজ জীবনে এত অস্থিরতার কারণ কী? পারিবারিক জীবনে কেন ঘটছে এত নিষ্ঠুরতম ঘটনা? এসবের কারণ আমরা সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে পারছি না। আমাদের বুঝতে হবে, সন্তানরা চায় পিতা-মাতা হোক বন্ধু এবং ভরসার স্থল। পিতা-মাতার সঙ্গে তারা প্রাণখুলে, অসঙ্কোচে, নির্ভয়ে সবকিছু শেয়ার করবে। মা হলেন সন্তানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মায়ের অকৃত্রিম মমতার মায়াজালে সন্তানকে বন্দি করতে পারলে পৃথিবীর আর কোনো জাদুশক্তির ক্ষমতা নেই যে সন্তানকে বিপথে নিয়ে যাবে।

একবার ভেবে দেখুন, ঘরে-বাইরে, সমাজে কী ঘটছে, কেন ঘটছে? এসবের কারণ কী? কারণ হলো- হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ। আর মূল্যবোধ হারানোর কারণটি হলো বিলুপ্ত হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারের শিকড়ের শক্তি। বাংলাদেশে সামাজিক, পারিবারিক প্রেক্ষাপট এখন ভিন্ন। আমাদের পরিবারগুলোতে আদি বন্ধনের ঐতিহ্য ধ্বংস হতে চলেছে। দাদা-দাদু, নানা-নানু, বাবা-মা, চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু, ফুফা-ফুফুর চিরায়ত পারিবারিক সম্পর্কগুলো ঘনিষ্ঠতা হারাচ্ছে। বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে শেয়ার করেন না দাদা-নানাদের ঐতিহ্যের কাহিনী, সংগ্রামী ব্যক্তি ও সংসার জীবনের গল্প। প্রিয় সন্তানকে বলা হয় না, তাদের সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রীতিনীতি এবং তার কাছে পিতা-মাতা কী প্রত্যাশা করেন। আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে সন্তানদের শেখাতে পারছি না যে মানুষের জীবনটা শুধু তার নিজের জন্য নয়। প্রতিটি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি পারিবারিক সংস্কৃতির ধারা, কিছু মূল্যবোধ এবং আদর্শ।

পারিবারিক বিনোদনের জায়গাগুলো ছোট হয়ে আসছে। বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে দেখা হয় না টিভির অনুষ্ঠান। যাওয়া হয় না সিনেমা হলে, নাট্যমঞ্চে। আত্মীয়তার সম্পর্কের রেওয়াজটাও আধুনিকতার নামে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আটকে গেছে। তাই আত্মীয়তার সামাজিক বন্ধনগুলো কাছে টানছে না সন্তানদের জীবন। আমাদের সুপরিসর সামাজিক সম্পর্কগুলোকে সুবিধাবাদের সম্পর্কে পরিণত করে এক ধরনের একক সমাজ ও পরিবারের অবয়বে একাকিত্বতার ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছি আমরা। বাবা-মায়েরা সন্তানের চাহিদা পূরণ করছি অর্থ দিয়ে। খোলা মাঠে শিশুদের সামাজিকীকরণ ঘটছে না। আমাদের শিশুরা প্রকৃতির আলিঙ্গন পাচ্ছে না। নগরসভ্যতা যেন সমৃদ্ধ শৈশবের সব আয়োজন গিলে ফেলছে।

আধুনিক ফ্ল্যাট কালচারের অদ্ভুত এক (অ)সভ্যতা বিরাজ করছে। বাসায় বাসায়, ঘরে ঘরে সহপাঠী ও খেলার সাথী বন্ধুদের আড্ডার সুযোগ না থাকলে ওদের বোধের পরিব্যাপ্তি বাড়বে না। অভিজ্ঞতা বিনিময় না হলে ওদের মনন ও জ্ঞানের জগৎ বড় হবে না। মানবিক সম্পর্ক তৈরি হবে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে তাদের সৃজনশীলতা দৃষ্টান্ত উপহার হিসেবে দিতে পারবে না। আমাদের সন্তানরা বাড়ি থেকে স্কুল, স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে। দিনবদলের প্রতিযোগিতায় আমরা হারাচ্ছি পারিবারিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি আর মানবিক মূল্যবোধ। সবাই ছুটছে টাকার পেছনে, যেন টাকা হলেই সব হবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। আমরা যারা অভিভাবক তাদের উপলব্ধির সময় এসেছে, ব্যাংকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমানো, ফ্ল্যাট-বাড়ি বা গাড়ি নিয়ে সুখী হওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা কখনো সুখ এনে দিতে পারবে না। কেননা সুখী হওয়ার জন্য প্রয়োজন আত্মতুষ্টি, সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন, ধর্মীয় চর্চা এবং চারপাশকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করা। তা না হলে একসময় দেখা যাবে আপনার বাড়ি, গাড়ি সবই ঠিক আছে, শুধু ঠিক নেই প্রিয় সন্তান।

-এস এম মুকুল, সমাজ বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads