• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
ব্যাঙ চাষে ঝুঁকি কম লাভ বেশি

ব্যাঙকে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবেও অভিহিত করা হয়

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

লাইভ ফার্মিংয়ে সম্ভাবনা

ব্যাঙ চাষে ঝুঁকি কম লাভ বেশি

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমরা জানি, ব্যাঙ প্রকৃতির বিস্ময় এবং পরিচিত উভচর প্রাণী। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি জমির উর্বরতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে ব্যাঙ। ব্যাঙের শরীরের সব উপকরণ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় খেয়ে ফসল সুরক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এজন্য ব্যাঙকে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবেও অভিহিত করা হয়। হতাশার খবর হচ্ছে, কীটনাশকের অতি ব্যবহার এবং বন-জঙ্গল উজাড় করায় জীববৈচিত্র্য রক্ষাকারী ব্যাঙের এখন আর খুব একটা দেখা মেলে না। প্রতিনিয়তই নষ্ট হচ্ছে ব্যাঙের বাসস্থান ও প্রজনন-আশ্রয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাঙের মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ব্যাঙের হাড় ও চামড়া দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী ও শোপিস তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাঙ চাষের মাধ্যমে আর্থিক সমৃদ্ধি, আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং ব্যাঙ রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। আরো আশার খবর হলো, দেশের সমুদ্র উপকূল ও মিঠাপানিতে চাষের উপযোগী প্রজাতি আবিষ্কার হয়েছে।

অধিক আয়ের সুযোগ

থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো আমাদের দেশের মৎস্যচাষিরা মাছ চাষের পাশাপাশি ব্যাঙ চাষ করেও বাড়তি লাভবান হতে পারেন। ব্যাঙের মাংস প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। উন্নত দেশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ছাড়াও আফ্রিকার অনেক দেশে নিয়মিত খাবারের মেন্যুতে থাকে ব্যাঙের মাংস। আমাদের দেশের চাকমা আর মারমাদের অনেক সুস্বাদু খাবার ব্যাঙের মাংস। ব্যাঙের মাংস প্রক্রিয়াজাত করে ফিশ ফিডে প্রোটিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাঙের দুই পা মানুষের খাবার উপযোগী। অন্যান্য অংশ মাগুর, পাঙ্গাশ, চিতল ও আইড় মাছের উৎকৃষ্ট খাবার। আবার পোল্ট্রি খাবার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এ ছাড়া ব্যাঙের মাথায় থাকা ‘পিটুইটারি গ্রন্থি’ মাছের প্রজনন কাজে ব্যবহার করা যায়। ব্যাঙের চামড়া দিয়ে মানিব্যাগ, হাড় দিয়ে মেয়েদের ছোট ছোট গহনা ও বিভিন্ন ধরনের শোপিস তৈরি করা যেতে পারে। স্বল্প পুঁজি, কম জায়গা, অধিক আয়ের সুযোগ থাকায় ব্যাঙ চাষে ঝুঁঁকি কম, লাভ বেশি। ব্যতিক্রম হওয়ার কারণে ব্যবসায় প্রতিযোগিতাও কম। পুকুর, ডোবা ও জলাভূমিতে অত্যন্ত সুষ্ঠু-সুন্দর ছায়াময় পরিবেশে ব্যাঙের চাষ করা যায়। এই চাষ পদ্ধতি শুধু কোলা ব্যাঙ বা সোনা ব্যাঙের জন্য উপযোগী। এই জাতের ব্যাঙ ৯ থেকে ১২ মাসেই বিক্রয়যোগ্য।

কৃষিতে ব্যাঙের গুরুত্ব

ব্যাঙ উভচর প্রাণী, যার অপর নাম ভেক। জাতভেদে ব্যাঙের খাদ্যের ভিন্নতা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাঙই পোকামাকড় ধরে খায়। ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে ও মানুষের অনেক উপকারে আসে। ব্যাঙের উপকারিতার শেষ নেই। অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাঙ অত্যধিক গুরুত্বের দাবিদার। কৃষিজমিতে ব্যাঙের মলমূত্র ও দেহাবশেষ পচে মাটির উর্বরতা শক্তি এবং ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শস্যক্ষেতের ঘাসফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, পামরী পোকা ও হলুদ মাজরা পোকা খেয়ে উপকার করে। ফলে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। মশা ও ছোট ছোট ক্ষতিকর জীব খেয়ে মানুষের উপকার করে।

 

ব্যাঙ গবেষণায় সাফল্য

cropped-Hasan-website-22

বাণিজ্যিকভাবে ব্যাঙ চাষ করে লাভবান হবেন চাষিরা
-ড. মাহমুদুল হাছান

জাপানে কর্মরত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতক শেষ করে ২০০৬ সালে ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা করেন বিজ্ঞানী মাহমুদুল হাছান। তিনি গবেষণা করে ব্যাঙের নতুন প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন, যা পৃথিবীবিখ্যাত এক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের ৪৩ প্রজাতির ব্যাঙ শনাক্ত করে সবগুলোর জীবনরহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে আবিষ্কৃত ব্যাঙের প্রজাতি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে দেশ লাভবান হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। গবেষক ড. মাহমুদুল হাছান বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল বা মিঠাপানির অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাঙের চাষ করা যায়। কারণ সেখানকার আবহাওয়া ব্যাঙ চাষের অনুকূলে। উৎপাদন ভালো হবে। নতুন আবিষ্কৃত ব্যাঙ দুটির নাম হলো যথাক্রমে Microhyla mukhlesuri এবং Microhyla mymensinghensis। প্রথম ব্যাঙটির নামকরণ করা হয়েছে বাকৃবির মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের প্রয়াত অধ্যাপক ড. মো. মোখলেসুর রহমানের নামানুসারে। কারণ তিনি বাকৃবি এবং হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি ‘যৌথ গবেষণা’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যার ফলে বাংলাদেশের অবহেলিত আম্ফিবিয়া ধীরে ধীরে বিশ্ব হারপেটোলজিস্টদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাঙটির নামকরণ করা হয় ব্যাঙটি সর্বপ্রথম ময়মনসিংহ জেলার বাকৃবি ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় বলে ময়মনসিংহের নামানুসারে। প্রথমটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল তথা রাউজান ও চট্টগ্রাম এলাকায় এবং দ্বিতীয়টি মধ্য ও মধ্য-পূর্ব অঞ্চল তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় পাওয়া যায়।

বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ ব্যাঙ খেতে পছন্দ করে। কাজেই ব্যাঙ রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে খুব সীমিত আকারে ব্যাঙ রফতানি হচ্ছে। বছরে  দেড়  থেকে ২ কোটি ডলারের ব্যাঙ রফতানি করা হয়। অথচ বিশ্বে সারা বছর প্রায় ৩২০ কোটি পিস ব্যাংকের চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি ব্যাঙের দাম প্রায় ১৬ ডলার। এ হিসাবে যার দাম প্রায় ৫ হাজার ১২০ কোটি ডলার। এর বড় অংশের জোগান দিচ্ছে চীন, ভারত ও মিয়ানমার। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ ৭৭১ টন ব্যাঙের পা বিদেশে রফতানি করে ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকার বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশ। মাছ চাষের মতো কৃত্রিম উপায়ে চাষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে রফতানি করে প্রতি বছর  কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।  দেশে একটি ‘ব্যাঙ গবেষণাগার’ করার পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় ব্যাঙ যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা এখন সময়ের চাহিদা।

ব্যাঙ চাষ লাভজনক

স্থান : হাজামজা পুকুর, ডোবা অথবা জলাজমি হলেই চলবে,  যেখানে গরমের সময় অন্তত এক ফুট পানি রাখা যাবে। বন্যার পানির প্রকোপ থেকে চাষ এলাকা বাঁচিয়ে রাখতে হবে, যাতে ব্যাঙাচি বেরিয়ে না পড়ে।

পুকুর : আদর্শ খামারের জন্যে দেড় বিঘায় দুটি পুকুর এবং একটি ছোট ডোবা রাখতে হবে। পুকুরের গভীরতা ৩ ফুটের বেশি নয়। পুকুর দুটি ও ডোবার চারদিকে বাঁশের বেড়া অথবা লোহার নেট অথবা নাইলনের শক্ত জাল একগজ উঁচু করে ও আধাহাত মাটিতে পুঁতে আটকে দিতে হবে।

পরিবেশ : ব্যাঙ সব সময় জালে থাকে না। তাই পুকুরের চার পাড়েই গাছ লাগিয়ে ছায়া তৈরি করা দরকার। কারণ ব্যাঙ বিশ্রামের জন্য ডাঙায় উঠে এসে ঝোপ-ঝাড়ের ছায়ায় বিশ্রাম করে।

সতর্কতা : ব্যাঙের প্রধান শত্রু সাপ। কোনোভাবেই সাপ ঢুকতে দেওয়া যাবে না। আবার চিল বাজপাখি যাতে ব্যাঙ ধরে নিতে অথবা উপদ্রব করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সাবান পানি, নর্দমার নোংরা পানি ও বিষাক্ত পানি কোনোমতেই পুকুরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।

বাজারজাতকরণ : ব্যাঙ নয় মাস থেকে ১২ মাসের মধ্যেই বিক্রয়যোগ্য হয়। কিছু ব্যাঙ তুলে বিক্রি করার পর বাকি ব্যাঙ তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে। দু’বছর পার হয়ে গেলে সব ব্যাঙ ধরে বিক্রি করে দিতে হবে। কারণ ব্যাঙ তিন বছরের  বেশি বাঁচবে না এবং মাংস শক্ত হয়ে যায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগ

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (প্রক্রিয়াধীন), মেলান্দহ, জামালপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads