• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ফিজিওথেরাপি বনাম ব্যথার ওষুধ

আমাদের সবচেয়ে বেশি ভোগায় তার মধ্যে ঘাড়, কোমর, হাঁটু, কাঁধ, হাতের কনুই, পায়ের গোড়ালি এবং পিঠব্যথা

ছবি : ইন্টারনেট

ফিচার

ফিজিওথেরাপি বনাম ব্যথার ওষুধ

  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

Dr. Mohammad alai

ডা. মোহাম্মদ আলী

অসুখ হলে ওষুধ খেতে হবে। আমাদের সাধারণ ধারণা এমনই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান কি একথা সবসময় সমর্থন করে? না, কারণ আধুনিক বিশ্ব ক্রমেই ওষুধ, বিশেষ করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে এমন ওষুধ গ্রহণের বিরোধী। এখন চিকিৎসার উদ্দেশ্য কেবল রোগ ভালো করা নয়, একটি রোগ ভালো করতে গিয়ে যাতে শরীরের অন্য ক্ষতি না হয়ে যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখেন আধুনিক চিকিৎসকরা। যেমন ধরুন শারীরিক ব্যথা; ব্যথানাশক ওষুধগুলো আমাদের শরীরে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে থাকে, যা অনেক সময়ই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

শারীরিক ব্যথার ধরন : যেসব শারীরিক ব্যথা আমাদের সবচেয়ে বেশি ভোগায় তার মধ্যে ঘাড়, কোমর, হাঁটু, কাঁধ, হাতের কনুই, পায়ের গোড়ালি এবং পিঠব্যথা অন্যতম। চল্লিশোর্ধ্ব নারী-পুরুষ সবচেয়ে বেশি ভুগে থাকেন। যারা দীর্ঘ সময় অফিসে বসে কাজ করেন অথবা প্রতিদিন অফিসে যাতায়াতের জন্য যানবাহনে বসে থাকেন, তাদের মধ্যে ব্যথায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এ ছাড়া ডায়াবেটিক রোগীদের ঘাড় কোমর হাঁটু ও কাঁধ ব্যথা বেশি হয়। তা ছাড়া যারা ভারী কাজ অথবা সংসারের কাজ, যেমন কাপড় কাচা ঘর মোছা ইত্যাদি অত্যধিক করে থাকেন, তাদেরও ব্যথায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।

ব্যথার ওষুধ কীভাবে কাজ করে : ব্যথার ওষুধ গ্রহণের ফলে এর উপাদান পাকস্থলী থেকে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছায় এবং কোষ থেকে একধরনের রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটায় যা বিভিন্ন মেকানিজম (যেমন পেইন গেট থিউরি) এর মাধ্যমে ব্যথার স্থানের প্রদাহ কমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যথার ওষুধ পাকস্থলী ও কিডনির মাধ্যমে শরীরে ছড়ায় বলে তা পাকস্থলীতে ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে অথবা আগে থেকেই পাকস্থলীতে ক্ষত বা আলসার থাকলে তা বাড়িয়ে দিতে পারে। একইভাবে দীর্ঘদিন কিডনি দিয়ে ব্যথার ওষুধ নিঃসরণ হলে কিডনির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া ব্যথার ওষুধ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন ঘাড়ব্যথার জন্য কেউ ব্যথানাশক সেবন করল, তা কি শুধু ঘাড়েই ছড়াবে? না, এই ওষুধের উপাদানগুলো রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে পৌঁছে যাবে এবং শরীরের সুস্থ অংশে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বিষয়টি মশা মারতে কামান দাগার মতোই অনভিপ্রেত। তাই দীর্ঘদিন ব্যথানাশক সেবন করলে তা শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবেই।

ফিজিওথেরাপি কীভাবে কাজ করে : ফিজিওথেরাপি স্থানীয় বা লোকাল চিকিৎসা। অর্থাৎ শরীরের যে অংশ ব্যথায় আক্রান্ত, সাধারণত সেই অংশেই ফিজিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। শুধু ব্যথা নিরাময়ই ফিজিওথেরাপির উদ্দেশ্য নয়, ব্যথার কারণ নির্ণয় করে তা নির্মূল করাই এর লক্ষ্য। ধরুন, পিএলআইডি বা কোমরের কশেরুকার চাকতি সরে গিয়ে তা স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোমর ও পায়ে ব্যথা সৃষ্টি করল। এক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধের কাজ কী? ব্যথানাশক কেবল সাময়িকভাবে ব্যথা কমাতে পারবে কিন্তু স্নায়ুর ওপর যে চাপ সৃষ্টি হলো, তা সরানোর ক্ষমতা ব্যথার ওষুধের নেই। পক্ষান্তরে ইলেকট্রোথেরাপির মাধ্যমে সাময়িক ব্যথা নিয়ন্ত্রণ এবং ম্যানিপুলেটিভ থেরাপির মাধ্যমে স্নায়ুর চাপ সরানো সম্ভব। অর্থাৎ ফিজিওথেরাপি ব্যথা ও ব্যথার কারণ দুটির ওপরই কাজ করে। তাই এটি দ্রুত ও কার্যকর এবং যেহেতু এটি কিডনি ও পাকস্থলীর ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, তাই এটি গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।

অন্যান্য রোগে ফিজিওথেরাপি : ব্যথা ছাড়াও স্ট্রোক প্যারালাইসিস, বেলস পালসি ইত্যাদিতেও ফিজিওথেরাপি বেশ কার্যকর। মুখ বেঁকে যাওয়া বা বেলস পালসিতে রোগীরা প্রদাহ ও ভাইরাসবিরোধী ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ফিজিওথেরাপি নেওয়া শুরু করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আর স্ট্রোক প্যারালাইসিস রোগীরা একজন ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা নিলে আবার কর্মক্ষমতা ও সচলতা ফিরে পেতে পারেন।

কোথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পাবেন : সঠিক ফিজিওথেরাপির প্রথম ধাপ হলো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। ঠিক কী কারণে আপনার শরীরে ব্যথা হচ্ছে, তা নির্ণয় করতে না পারলে কখনোই ফিজিওথেরাপি ফলপ্রসূ হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হার্টের রোগ বা প্রেসার থেকে অনেক সময় ঘাড় কাঁধ বা বুক ব্যথা হতে পারে কিন্তু কারণ না জেনেই যদি এসব ক্ষেত্রেও ফিজিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়, তা কি কাজ করবে? তাই প্রথমেই ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞকে রোগ নির্ণয় করার সুযোগ দিতে হবে। আবার অনেকেই ফিজিওথেরাপির নামে না জেনে বিভিন্ন ধরনের ম্যাসাজ বা মালিশ বা টানাটানি করে থাকেন। এটিও হিতে বিপরীত ফল আনতে পারে। তাই একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ফিজিওথেরাপি নিলেই তা সবচেয়ে ভালো ফল দেবে। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা সেন্টারে ফিজিওথেরাপি না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

শেষ কথা : ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই চিকিৎসা নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই। একজন রোগীর সুস্থ হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই ফিজিথেরাপি নেওয়া উচিত। অনেকেই মনে করেন, সাময়িক আরাম পাওয়ার জন্যই ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। সাময়িক ব্যথামুক্তির জন্য আপনি ব্যথানাশক খেতে পারেন, কিন্তু ফিজিওর মূল উদ্দেশ্য হলো রোগীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যথা ও ব্যথার কারণ মুক্ত করা এবং প্যারালাইসিস সহ অন্যান্য অচল রোগীর সচলতা ফিরিয়ে দেওয়া। ফিজিওথেরাপি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি।

লেখক : বাত ব্যথা ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ

হাসনা হেনা পেইন অ্যান্ড ফিজিওথেরাপি রিসার্চ সেন্টার (এইচপিআরসি)

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads