• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
নাটকে স্বদেশ-অন্বেষা

প্রতীকী ছবি

ফিচার

আবদুল্লাহ আল মামুন

নাটকে স্বদেশ-অন্বেষা

  • রহমান রাজু
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের নাট্যকার শিরোনামের পরিচিতি ও প্রসিদ্ধিতে যে ক’জন নাট্যপুরুষের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন অগ্রগণ্য। একদিকে থিয়েটারকর্মী, অন্যদিকে নাট্যকার— দুয়ের মনিকাঞ্চনযোগে আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলা নাটকের বিষয়ভূমিতে চাষ করে যে উর্বর ফসল উপহার দিয়েছেন, তা বিস্ময় ও অর্জনের। বাংলাদেশের মহাকাব্যিক অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ, সেটা তার মূলভূমি। তবে তার দক্ষতা সেখানেই যে তা মুক্তিযুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমকালীন বিবিধ পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবেলা করেই তার নাটকের ঘটনাগুলো ত্বরান্বিত। গল্পগুলো আমাদের চারপাশের; কিন্তু নাটকীয় উপস্থাপনা তার। হয়তো কখনো ভেবে দেখা হয়নি যেমন করে ঠিক তেমন করেই তার নাটকের বিষয়ে আসে বাংলা ও বাংলার মানুষ। মুক্তিকামী-যুদ্ধংদেহী সে মানুষের নিত্যকার দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ জীবন, ভণ্ড রাজনীতি, ধর্মের বাড়াবাড়ি, মনুষ্যত্বের অবমাননা সর্বোপরি বেরিয়ে আসা মানুষের সন্ধান মেলে তার নাটকে। স্বাধীনতা-উত্তর কালেই বাংলাদেশে নাটকের ভূমি উর্বর হয়ে ওঠে শিল্পের অন্যান্য শাখার তুলনায়। আবদুল্লাহ আল মামুন সে ভূমির ঘর্মাক্ত শ্রমিক সন্দেহ নেই। ‘তার প্রাণের ভেতরে নাটক, তার সত্তার শেকড়ে নাটক। আর শেকড়ের সেই জমিটা হচ্ছে আমাদের এই মাতৃভূমি, মুক্তিযুদ্ধজাত বাঙালির এই স্বদেশ।’ প্রগতিমনস্ক সমাজভাবনায় তার নাটকে উঠে আসে সমসাময়িক বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ; আমাদের চারপাশের বিষয়। তাকে সমাজ ও সমকালের নাট্যকার বললেও যথার্থই বলা হয়।

আবদুল্লাহ আল মামুন মূল্যবোধের অবক্ষয়িত বাংলাদেশের চমৎকার স্কেচ তৈরি করলেন ‘সুবচন নির্বাসনে’ নাটকে। ’৭৪-এ নাটকটি যখন রচিত ও অভিনীত হয়, তখন আমাদের চারদিকে বিরাজ করছিল যুদ্ধোত্তর এক হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয়। ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা’- জীবনানন্দ দাশের প্রতীকায়িত উক্তির প্রতিফলন সুবচন নির্বাসনে। অর্জিত স্বাধীনতার প্রয়োগসীমাবদ্ধতা সমাজজীবনে অস্বস্তি বয়ে আনে; অপশক্তির কবল থেকে সদ্যমুক্ত একটি দেশে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় দানা বাঁধতে থাকে, মেধাহীনদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়, ঘুষের মতো অসততার কাছে সততা পরাজিত, প্রশ্নবিদ্ধ দেশ-মাটি-স্বাধীনতা। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে আদর্শবান মানুষদের কষ্টের অন্ত নেই, নষ্ট পচাদের দখলে চলে যাবে সব! সর্বত্রই মূল্যবোধের অবক্ষয়। এমন পরিস্থিতিতে সুচিন্তা-সুকথা দ্বীপান্তরিত। নীতি আদর্শ সবই মিথ্যে যেন। সত্য প্রহসনমাত্র। মেধা মূল্যহীন। তাই সুবচন নির্বাসনে। ‘মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে সর্বব্যাপ্ত হতাশা, প্রত্যয় প্রমূল্যের অবক্ষয় এবং সামাজিক বৈনাশিকতার প্রেক্ষাপটে রচিত এ নাটকটি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী নষ্ট সময়ের চালচিত্র হিসেবে এক শৈল্পিক সামাজিক দলিল। এ নাটকে রূপকের র্যাপিংয়ে উপস্থাপিত আদালতটি মূলত আমাদের চিরচেনা আদালত, যেখানে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের হাজির হতে হয় নিত্যই। পরিবারের সন্তানদের আদালতে আদর্শবান বাবা আজ আসামি। কেননা সৎ আদর্শবান বাবা সন্তানদের শিখিয়েছিল তিনটি নীতিকথা- ক. সততাই মহৎ গুণ; খ. লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে; গ. সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে- এর কোনোটিরই বাস্তব ফল সুখকর নয় সমকালে। অন্যায়ের কাছে হার মানতে রাজি নন আদর্শবান বাবা অথচ শেষাবধি তারও পরাজয় ঘটে। বাবা বলেন, ‘...প্রমাণ করুন সত্য অচল হয়ে গেছে। জ্বলছে শুধু মিথ্যার হুতাশন। আমি অপরাধী, দয়া করে আমাকে আপনারা শাস্তি দিন।’ পরাজিত বাবার এ আবেদন নিঃসন্দেহে প্রতিবাদ- সমকালীন বাস্তবতার বিরুদ্ধে।

একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার জীবনচিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি রেললাইন সংলগ্ন ‘গলাচিপা’ বস্তির মানুষজনের জীবনসংগ্রাম তার ‘এখনও ক্রীতদাস’ নাটকের বিষয়। মুক্তিযোদ্ধা বাক্কা একসময় ট্রাক ড্রাইভার ছিল। এখন হতদরিদ্র অবস্থায় গলাচিপা বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছে। জীবনের সঙ্গে দারিদ্র্য গেঁথে গেছে। দারিদ্র্য যেন জীবনের ক্রীতদাস। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি, হয়নি সঠিক মূল্যায়নও। মুক্তিযোদ্ধা বাক্কা মিয়া বলে, ‘আসল মুক্তিবাহিনী? অই শালা বেক্কল, আমি যদি আসল মুক্তিবাহিনী হই তাইলে দ্যাশে জাগা পাই না ক্যান? ঘর নাই ক্যান? বাড়ি নাই ক্যান? বাপদাদার ভিটা গ্যালো কই? একখান ঠ্যাং লইয়া গলাচিপা বস্তির মইদ্যো ঘাউয়া কুত্তার মতন কাইমাই করতাছি। মায়ে ঝিয়ে মিল্যা আমারে বান্দর নাচ নাচাইতাছে। একজন কয় লুলা আরেকজনে কয় শালা। হারেস আলী, তুই দেহিস আমি ঠিক একদিন ওই দুই মাগীরে খুন কইরা সুইসাইড খামু।’  রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি ধিক্কার বাক্কা মিয়ার। মুক্তিযুদ্ধে পা হারিয়ে সে কারো কাছে লুলা আর কারো কাছে শালা। একজন বাক্কা মিয়ার জীবনযুদ্ধ এবং প্রকারান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশাজনক প্রাপ্তির রেখাচিত্র এ নাটকটি।

তরুণ-সমাজের বিপথগামিতার বয়ান ‘তোমরাই’। মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে তরুণ সমাজ স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা ব্যবহূত হলে আবদুল্লাহ আল মামুন ব্যথিত হন। তরুণদের উদ্দেশ করে লেখেন ‘তোমরাই’। তিনি শঙ্কিত হন এই ভেবে যে, এভাবে যদি স্বাধীনতাবিরোধীচক্রের হাতে তরুণরা ব্যবহূত হতে থাকে, তাহলে একদিন দেশপ্রেম-চেতনা ঝিমিয়ে পড়বে। মহাউত্থান ঘটবে মৌলবাদী শক্তির। তরুণ সমাজকে এ অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা জরুরি। নাটক যেহেতু সরাসরি দর্শকের সামনে ঘটনা হয়ে উপস্থাপিত হয়, সেহেতু নাট্যকারের উদ্দিষ্ট সমাজের অসঙ্গতি সুনির্দিষ্ট করে তা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান। ‘তোমরাই’ নাটকে তরুণদের অবক্ষয় এবং পরিসমাপ্তিতে মায়ের আকুতি এ যুবসম্প্রদায়কে বিপথগামিতার পথ থেকে ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাজাকার মৌলবাদী- স্বাধীনতাবিরোধী- দেশশত্রু হায়দারেরা তরুণ সমাজকে টার্গেটে আনে। নানারকম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বিপথের দিকে উৎসাহিত করে। কেননা এ বয়স কোনো নিয়ম মানে না। সে সুযোগই গ্রহণ করে হায়দারেরা। একদিকে রাজনীতির বাইরে থাকার আহ্বান; অন্যদিকে বোমা-পিস্তলের ইঙ্গিত এবং নগদ টাকা। ভালো কথা একটির ভেতর দিয়ে দুটি কুপ্রস্তাবনার বাস্তবায়ন ঘটায় হায়দার। অর্থের প্রতি আকৃষ্ট ও পিস্তল-বোমার ইঙ্গিত। তারুণ্যের বল্গাহীন বৈশিষ্ট্যকে কীভাবে দখলে আনতে হয়, তার সব কৌশল এদের জানা। এরা সফলও হয়। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে দেশ একদিন বেহায়াদের দখলে চলে যাবে। সন্তানরা বিপথগামী হওয়ায় একজন জননীর কাছে স্বাধীনতার অর্থ পাল্টে যায়। স্বাধীন দেশে যুবসম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করার কোনো রাষ্ট্রিক উদ্যোগ না থাকায় ঘরে ঘরে অসংখ্য রঞ্জু জন্ম নেয়। যে রঞ্জুরা হায়দারদের দ্বারা ব্যবহূত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করতে পর্যন্ত উদ্যত হয়। মায়ের প্রশ্ন, ‘স্বাধীন দেশে আছ কেমন ননীদা? নিজের পাওনা বুঝে পেয়েছ? আমার দিকে তাকাও। স্বাধীন দেশ আমাকে আমার পাওনা পাই পাই বুঝিয়ে দিয়েছে। পুরো তিনটি মাস স্বামীকে ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখে পাগল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ঘর জ্বালিয়েছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি পাগলের মতো এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়িয়েছি। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে সেই কবে ননীদা। আমাদের কমিটমেন্ট কি আমরা রাখতে পেরেছি?’ মায়ের এ উক্তি থেকে জাতিকে লজ্জা দিয়ে নবতর চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় নাটকটিতে। আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটকের এ এক স্পর্শকাতর ঢঙও বলা চলে।

‘মাইক মাস্টার’ নাটকে মাইক মাস্টার বামপন্থি রাজনৈতিক দলের কর্মী। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ধৃত। মাইক মাস্টার দেখতে পায় রাজনীতির সঙ্গে নীতির কোনো সম্পর্ক নেই, সবকিছুই ভণ্ডামি। স্বার্থপরতার নীতি এখানে কার্যকর। বড় ব্যবসা চলে এই রাজনীতি নিয়েই। জাতি হয়ে পড়েছে অকৃতজ্ঞ। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন নেই। অর্থনৈতিক মুক্তি নেই। সামাজিক শৃঙ্খলা নেই। মানবিক সম্পর্কের উন্নতি নেই অথচ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের শিরোন্নত জাতি বাঙালি। নামেই যেন শেষ। জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য নেই তার বুকে। রাজনীতির নামে অপরাজনীতি নিয়ে সবাই এখন ব্যস্ত। মাইক মাস্টার তাই মাইক বাজিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দেন অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা, জাতীয় চেতনার কথা। নাটকটির শেষাংশে মাইক মাস্টারের আহ্বান, ‘প্রেমের শক্তিতেই বাঙালির হূদয়ের আসনে সম্মানের সঙ্গে অধিষ্ঠিত হোক জাতির পিতা, একজন বঙ্গবন্ধু, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শহীদ জননী এবং— এবং একজন মরহুম হজরত আলী, পিতা মৃত, একাব্বর আলী মুন্সি, গ্রাম বাংলাদেশ, পোস্ট অফিস বাংলাদেশ, জেলা বাংলাদেশ, দেশ বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশ হোক আমাদের সর্বোচ্চ অহঙ্কার। অকৃতজ্ঞ জাতির মতো ভুলে গেলে চলবে না আত্মপরিচয়। অপরাজনীতির বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সৎ রাজনীতির চর্চা করতে হবে। এমন ঘোষণাই ‘মাইক মাস্টারে’ ঘোষিত।

স্বদেশ নিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুনের একইসঙ্গে রয়েছে অহঙ্কার ও দীর্ঘশ্বাস। অবক্ষয়িত বাস্তবতা যেমন তাকে ব্যথিত করে, তেমনি বাংলাদেশ নামটি করে গর্বিত। ভালোমন্দ দুইয়ে মিলে তার নির্মিত ‘স্বদেশ’ নাটকে তার প্রতিফলন শিল্পিত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads