• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী

প্রয়াত রমা চৌধুরী

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী

  • কামরুল আহসান
  • প্রকাশিত ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

১৯৭১ সালের ১৩ মে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বিদুগ্রামে স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষিকার বাড়ি। দেশজুড়ে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের ভয়ে স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে স্বামী কোথায় যেন পালিয়ে গেছেন। এ অবস্থায় সেই শিক্ষিকা নারী সংসার আগলে রাখেন দু’হাতে। সকালবেলা স্থানীয় রাজাকারের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় বাড়িটিতে। ২০ বছরের গৃহবধূ নারীটির দিকে চোখ যায় এক সৈনিকের। সৈনিকটি তাকে ধর্ষণ করতে উদ্ধত হয়। ঘরের জানালা ধরে তখন দাঁড়িয়ে আছে নারীটির দুই ছেলে আর মা। বাড়ির পোষা বেড়ালও উঁকি দিয়ে আছে। সেদিন সেই নারী ধর্ষিত হলেন। তার সম্ভ্রমের বিনিময়ে একটি দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পর নিজের সেই পাশবিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন চোখের জলে ভেজা অসামান্য এক আত্মজীবনী : ‘একাত্তরের জননী’। সেই মহীয়সী নারী রমা চৌধুরী।

সেদিনের সেই অমানবিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও তিনি ভেঙে পড়েননি। শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সংসারটাকে দাঁড় করিয়েছেন। সহায়-সম্বলহীন বাকি আটটি মাস তিনি দুই ছেলে সাগর, টগর আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে দিন পার করেছেন। হানাদার বাহিনী তার বাড়িটিও পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। পোড়া ভিটায় কোনো রকমভাবে পলিথিন আর খড়কুটো মাথায় আর গায়ে দিয়ে রাত কাটিয়েছেন। এভাবে বহু কষ্টে যুদ্ধের দিনগুলো পার করেন। কিন্তু ভাগ্য কতটা নির্মম হতে পারে তার উদাহরণ রমা চৌধুরীর জীবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র চার দিন পর মারা যায় তার আদরের সন্তান সাগর। ১৫ ডিসেম্বর থেকেই তার শ্বাসকষ্ট উঠেছিল। হিন্দুরীতি অনুযায়ী তিনি ছেলেকে পোড়াতে দেননি, কবর দিয়েছিলেন। এই বাংলার মাটিতেই শুইয়ে দিয়েছিলেন। ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনি আর জুতাপায়ে হাঁটতেন না। যে মাটিতে তার আদরের ধন ঘুমিয়ে আছে, সেই মাটির ওপরে তিনি কীভাবে জুতাপায়ে হাঁটবেন! পারলে বুক দিয়ে হাঁটতেন। একই অসুখে মারা যায় তার দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর।

তবু তিনি ভেঙে পড়েননি। কলম হাতে তুলে নিলেন। লিখলেন একটি দেশের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের গল্প। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন সাহিত্য সাধনায়। সারা জীবনে তিনি বিপুল কর্মযজ্ঞ করে গেছেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা সব মিলিয়ে তার ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে ভৃত্য’, ‘নজরুল প্রতিভার সন্ধানে’, ‘স্বর্গে আমি যাব না’, ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যে জীবনদর্শন’, ‘শহীদের জিজ্ঞাসা’, ‘নীল বেদনার খাম’, ‘সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘ভাববৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা রোহিনী চৌধুরীকে হারান। মা মোতিময়ী চৌধুরী শত বাধা পেরিয়ে তাকে পড়াশোনার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে যান। মায়ের অনুপ্রেরণায় ১৯৫২ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বোয়ালখালীর মুক্তকেশী গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৬ সালে কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ষাটের দশকে নারীদের উচ্চশিক্ষা এত সহজ ছিল না। সে সময় রমা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিনিই প্রথম নারী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল।

গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রিয় বাংলাদেশকে ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। আর ফিরবেন না। তার শারীরিক মৃত্যু হয়েছে; কিন্তু একজন রমা চৌধুরীর কখনোই মৃত্যু নেই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বাঙালির চোখের পানিতে লেখা থাকবে এই মহত্তম জননীর নাম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads