• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
পাহাড়ধস আতঙ্ক

পাহাড়ধসের ১৫ মাস পূর্ণ হয়েছে

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

পাহাড়ধস আতঙ্ক

  • রাঙামাটি প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বৃষ্টি-বজ্রপাত, ঝড়-তুফানসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ বৈরী আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে চরম আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লাখো বাসিন্দা। পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে বিগত বছরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ পাহাড়ধসে সর্বস্ব হারানো কয়েক হাজার পরিবারসহ তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষত এখনো পুরোপুরি শুকায়নি। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরে আজ পর্যন্ত রাঙামাটি জেলাকে সিকি ভাগও পুনর্গঠন করা যায়নি। এ অবস্থায় আবারো সেই অজানা আতংকে শংকিত প্রতিটি ক্ষণ পার করছে রাঙামাটিবাসী।

এদিকে গত বর্ষায় রাঙামাটিতে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ক্ষতির কবলে পড়া রাস্তাঘাট যেমন যথাযথভাবে মেরামত করা যায়নি, তেমনি ফাটল ধরা সরকারি ভবনগুলোও স্থায়ীভাবে মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, গত জুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অর্ধশতাধিক ভবনের বেশিরভাগই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গত বর্ষায় ধসের কবলে পড়া এই ভবনগুলো তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এখনো সেই অবস্থায়ই রয়েছে। এতে ভবনগুলোতে বসবাস এবং কর্মরত লোকজন ছাড়াও ভবনের পাশের বাসিন্দারাও চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

গত বছরের ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড়ধসের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয় আবার ঘুরেফিরে তাড়া করছে রাঙামাটির মানুষকে। তবু বিধ্বস্ত ভিটায় বহু মানুষকে বাস করতে হচ্ছে ঝুঁকিতে। শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ এখনো বাস করছেন পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে, যাদের যাওয়ার সুযোগ নেই কোথাও। সরকার বলেছে, ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে বাড়িঘর করে দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে। দুর্যোগের সময় সম্ভাব্য আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর তালিকা করা হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতভিটা ছেড়ে নিরাপদে চলে যেতে নির্দেশনা জারি করেছে প্রশাসন। কিন্তু স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এখনো সম্ভব হয়নি প্রশাসনের পক্ষে। ফলে আবার দুর্যোগের সম্ভাবনা নিশ্চিত বুঝেও অনেক মানুষকে বাস করতে হচ্ছে নিজ নিজ বসতভিটায় জানমালের ঝুঁকি নিয়ে।

এ ব্যাপারে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের লোকজনকে স্বেচ্ছায় নিরাপদে সরে যেতে বলা হচ্ছে। আগেভাগেই আশ্রয় কেন্দ্র খোলার প্রস্তুতি আছে। এছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলা ও দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার ও মেরামত কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, খাদ্য, ত্রাণ, জ্বালানি মজুত রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, ২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড়ধসের দুর্যোগে রাঙামাটিতে ১২০ জনের প্রাণহানিসহ ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। আমরা আর রাঙামাটিতে এ ধরনের কোনো দুর্যোগে প্রাণহানি চাই না। চাই না ব্যাপক কোনো ক্ষতি। এ জন্য আগের বছরের অভিজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করা লোকজনকে স্বেচ্ছায় নিরাপদে সরে যেতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় বাস করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান তাদের ছাড়তে হবে। অন্যথায় প্রশাসন উচ্ছেদে বাধ্য হবে। উপযুক্ত জায়গা না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।

জানা যায়, এভাবে ভেদভেদী, যুব উন্নয়ন অফিস এলাকা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলী, রূপনগরসহ রাঙামাটি শহর এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এখনো ঝুঁকিতে বাস করছে অসংখ্য মানুষ। শুধু রাঙামাটি শহরে ৩৩ স্থান এবং ৫৬৩ পরিবারকে পাহাড়ধসের ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারকে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাইনবোর্ড বসিয়ে সেখানে বাস করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৩ জুন ভয়াল পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় প্রায় দেড় শতাধিক।

বর্ষা মৌসুমের আগে এবারো ঝুঁকিমুক্ত হচ্ছে না রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুর্যোগ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় থেকে গতবারের মতোই সর্বাত্মক সাপোর্ট দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। অথচ জুনের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের ১২৮টি স্থানে স্থায়ী মেরামত ও পুনর্নির্মাণ কাজ করতে ব্যাপক ‘দৌড়ঝাঁপ’ করে রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ। দফতরটি গত ১৬ এপ্রিল ১৭০ কোটি টাকার ডিপিপি সাবমিট করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে অর্থছাড় না হওয়ায় কাজে হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

পাহাড়ধসের ১৫ মাস পূর্ণ হয়েছে। অথচ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত রাঙামাটি-চট্টগ্রামসহ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো আজো বেহাল। ফলে আবারো সড়কধসের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। রাঙামাটি সদরসহ জেলার সাত উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের অন্তত ১০ লাখ মানুষ এসব সড়কের ওপর নির্ভরশীল।

দুর্যোগের পর এসব ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে গাছের খুঁটি আর মাটি ভরাট করে কেবল সাময়িক সংস্কারেই ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। অথচ এ টাকা খরচ করেও ঝুঁকি এড়াতে পারছে না রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) হিসাব অনুযায়ী, রাঙামাটি শহরে ৩৩, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে ৫৬, রাঙামাটি বান্দরবান সড়কে ২৬, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়কে ৫ ও বগাছড়ি- নানিয়ারচর- লংগদু সড়কে ৩টি স্থানসহ ১২৮টি স্থানে সড়ক ধসে গেছে। এসব স্থানে স্থায়ী কাজের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

এর আগে পাহাড়ধসের পর এসব সড়কের ১১৩টি স্থানে ভাঙন ও গর্েতর সাময়িক সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে সাড়ে আট কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের সাপছড়ি শালবাগান এলাকায় ধসে যাওয়া মূল সড়কের ওপর অস্থায়ীভাবে যান চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে একটি বেইলি সেতু, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

জেলা প্রশাসন জানায়, গত বছর ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়ে সরকারিভাবে খোলা হয়েছিল ১৯ আশ্রয় কেন্দ্র। ওইসব কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিলেন দুর্যোগে স্বজন ও বাড়িঘর হারানো প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। ওই পাহাড়ধসের ঘটনায় শহরসহ জেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ১ হাজার ২৩১ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ হাজার ৫৩৭। প্রাণহানি ঘটে ১২০ জনের।

এদিকে অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত, জলাবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ও স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় ও বৃক্ষ নিধনসহ বিভিন্ন কারণ পাহাড় ধসের দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। এসব কারণ প্রতিরোধ করে সম্ভাব্য পাহাড়ধস ও দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পাহাড় ও বৃক্ষনিধন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, পরিকল্পিত বাড়িঘর ও স্থাপনা নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ ও বসবাস নিষিদ্ধকরণ, আবহাওয়ার সতর্কীকরণ পূর্বাভাস প্রচার, স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, অবৈধ কাঠ পাচার ও আসবাবপত্র পরিবহন নিয়ন্ত্রণ, দুর্যোগ মোকাবেলা কমিটি গঠন, উদ্ধার কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রস্তাব উঠে আসে বিভিন্ন প্রতিবেদনে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads