• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
প্রান্তিক কৃষকের নতুন জানালা

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাশরুর

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

কৃষি বায়োস্কোপ

প্রান্তিক কৃষকের নতুন জানালা

  • এসএম মুকুল
  • প্রকাশিত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাশরুর, যিনি কৃষির উন্নয়নে তথ্যচিত্র ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ তৈরি করে লাখো মানুষের নজর কেড়েছেন। তার ভিডিও গ্রামের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় কৃষি বার্তা। যার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে তিনি সরকারের উদ্ভাবনী বিভাগে শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার পুরস্কার পেয়েছেন। সফল কৃষকদের মডেল হিসেবে দেখিয়ে তিনি এ পর্যন্ত ১০০টি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। তার উদ্ভাবিত কৃষি বায়োস্কোপ গ্রামে গ্রামে প্রজেক্টরে প্রদর্শন ও স্থানীয় ক্যাবল টিভিতে প্রচার হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকের জন্য তথ্য-পরামর্শের নতুন জানালা কৃষি বায়োস্কোপের উদ্ভাবকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বিস্তারিত জানাচ্ছেন- এসএম মুকুল

‘কৃষি বায়োস্কোপওয়ালা’ নামে আপনার ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা কেমন লাগছে?

তালহা জুবাইর মাশরুর : ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ শব্দটার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে জেনে ভালো লাগছে। ব্যক্তিগত পরিচিতির চেয়ে প্রান্তিক কৃষকের নতুন জানালা কৃষি বায়োস্কোপের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ুক সেটাই প্রত্যাশা।

 

কৃষি উন্নয়নে পরামর্শ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে এই উদ্ভাবনে কৃষকরা কীভাবে উপকৃত হচ্ছেন?

তালহা জুবাইর মাশরুর : কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিওগুলো দেখে ইতোমধ্যে অনেকেই কৃষিতে আগ্রহী হয়েছেন। জমি লিজ নিয়ে শুরু করছেন প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি খামার। চাষাবাদের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সমাধানও পাচ্ছেন।

 

সরাসরি কৃষকরা কীভাবে আপনার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন?

তালহা জুবাইর মাশরুর : কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিওগুলো কৃষক প্রশিক্ষণে ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা হয়।  দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষি অফিসারদের মাধ্যমে কৃষক প্রশিক্ষণে কিংবা সন্ধ্যার পর গ্রামে গ্রামে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্রামের চায়ের দোকানে ডিশ লাইনে ভিডিওগুলো দেখানো হচ্ছে। আশার ব্যাপারটি হলো, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে অনেক কৃষকই স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টও আছে। এর ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও কৃষকরা ভিডিওগুলো দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। কৃষির সমস্যা, সমাধান ও সম্ভাবনা বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরে অনেক তথ্য জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই কৃষি বায়োস্কোপ ভিডিওগুলো দেশ-বিদেশের কৃষক ও কৃষি ক্ষেত্রে আগ্রহীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কৃষকরা সরাসরি মোবাইলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ (বীজ, চারা, সার, মালচিং পেপার ইত্যাদি) কিংবা প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন। আরো মজার ব্যাপার হলো- দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকে আমার অফিসে আলোচনার জন্য আসছেন। আমিও আন্তরিকতার সঙ্গে সঠিক পরামর্শ প্রদানের চেষ্টা করছি।

 

‘কৃষি বায়োস্কোপ’ নামকরণের মাহাত্ম্য কী?

তালহা জুবাইর মাশরুর : ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক কৃষক প্রশিক্ষণে ৩০ জন কৃষাণ-কৃষাণীকে প্রশিক্ষণে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে কৃষিবিষয়ক কয়েকটি ভিডিও দেখাচ্ছিলাম। ভিডিও দেখানো শেষে একজন কৃষক বললেন- ‘স্যার, আমাদের এই যে বায়োস্কোপ দেখালেন, এটা যদি আমাদের গ্রামের বাজারে দেখানো যেত তাহলে আরো অনেক কৃষকের উপকার হতো।’ তখন আমি লক্ষ করলাম মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে দেখানো ভিডিওকে কৃষকরা বায়োস্কোপের সঙ্গে তুলনা করছেন। এরপর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে যখন প্রজেক্টরের মাধ্যমে কৃষি তথ্যচিত্র দেখাতে গেলাম, সেখানেও কৃষকরা এটাকে আধুনিক বায়োস্কোপ হিসেবে বলতে শুরু করলেন। সেখান থেকেই ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ নামটা ব্যবহারের ভাবনা আসে।

 

কবে থেকে কৃষি বায়োস্কোপের যাত্রা শুরু করলেন?

তালহা জুবাইর মাশরুর : ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতে কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুলটিয়া গ্রামে প্রজেক্টর দিয়ে ‘কৃষি বায়োস্কোপ’-এর প্রথম প্রদর্শনী দেখানো হয়। এদিন বোরো ধান, ভুট্টা ও শীতকালীন সবজি চাষের কৌশল ও রোগ পোকামাকড় দমনের উপায় বিষয়ে কয়েকটি ভিডিও দেখানো হয়। স্থানীয় কয়েকজন সফল কৃষককে তথ্যচিত্রগুলোতে রাখা হয়, ফলে পরিচিতজনের মুখ থেকে কথা শুনে কৃষকরা সহজেই অনুপ্রাণিত হন।

 

কীভাবে এই কার্যক্রমকে আরো প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

তালহা জুবাইর মাশরুর : বর্তমান সময়ে দ্রুত বেশি মানুষের কাছে প্রচারের জন্য ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়াই জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। যেমন সজনে গাছের বিস্ময়কর গুণাগুণ নিয়ে ‘কৃষি বায়োস্কোপে’র একটা ভিডিও কয়েক মাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ, ইউটিউবে ১২ লাখ দেখেছে। আধুনিক কৃষি যন্ত্র কম্বাইন হার্ভেস্টার নিয়ে কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিও দেখেছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। এ ছাড়া আমের মুকুল আসার সময় কী করণীয় কিংবা ধানের ক্ষেতে বিপিএইচ বা কারেন্ট পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে করণীয়, থাই পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ বা লাভজনক তেজপাতার চাষ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে করা ভিডিওগুলো ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এভাবেই কৃষিক্ষেত্রে টেকসই প্রযুক্তিগুলো দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমি মনে করি সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব কৃষিবিদ কৃষকদের কল্যাণে কাজ করছেন তারা যদি ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ কনসেপ্টটি অনুসরণে কৃষির নতুন নতুন লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে ছোট ছোট ডকুমেন্টারি তৈরি করেন এবং কৃষক প্রশিক্ষণে ব্যবহার করেন তাহলে কৃষকরা সহজেই সেগুলো থেকে উপকৃত হবে। 

 

এ পর্যন্ত আপনি কতগুলো তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, কতগুলো প্রদর্শিত হয়েছে এবং কী কী বিষয়ে?

তালহা জুবাইর মাশরুর : এ পর্যন্ত ১০০টা তথ্যচিত্র তৈরি করেছি যার মধ্যে ৯৮টি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, কৃষক প্রশিক্ষণ ও সান্ধ্যকালীন কৃষি বায়োস্কোপে প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কম্বাইন হার্ভেস্টার, সামার টমেটো, অফসিজন তরমুজ, সজনে পাতার গুণাগুণ, স্কোয়াশ চাষ, ভার্মি কম্পোস্ট, থাই পেয়ারা, থাই বারোমাসি আম, অ্যাভোকাডো, গ্রাফটিং প্রযুক্তি, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ইত্যাদি। 

 

বাস্তবভিত্তিক এমন প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষক সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি ও কৃষি উন্নয়নে সরকারের কাছে আপনার কোনো পরামর্শ বা প্রস্তাবনা আছে?

তালহা জুবাইর মাশরুর : আমাদের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম আধুনিক কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হলে দেশের সামগ্রিক কৃষি আরো সমৃদ্ধ হবে। কৃষি যে একটা লাভজনক সেক্টর, খাদ্য উৎপাদন যে একটা মহৎ পেশা সেই বিষয়টা তাদের উপলব্ধিতে নিয়ে আসতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে এই শিক্ষিত যুবকদের হাত ধরেই দেশে আধুনিক কৃষির বিপ্লব ঘটবে। কিন্তু তাদেরকে মোটিভেট করা কিংবা লাভজনক উচ্চ মূল্য ফল-ফসলের আবাদ ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার মতো তথ্যচিত্র বা ডিজিটাল কন্টেন্টের স্বল্পতা রয়েছে আমাদের। কৃষির নানা প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নিয়ে আরো টেকনিক্যাল ভিডিও ডকুমেন্টারি বানানো সম্ভব হলে এবং দেশব্যাপী তা প্রচারের ব্যবস্থা করা হলে সাধারণ কৃষক যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তাও তৈরি হওয়ার অনেক সুযোগ, সম্ভাবনা আছে। তাই আমি মনে করি, সামনের দিনগুলোতে কৃষিতে তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা বাড়বে। ‘কৃষি বায়োস্কোপের’ এই আইডিয়া কাজে লাগিয়ে সহজ উপায়ে কৃষি তথ্য সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে জাতীয়ভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সামগ্রিকভাবে কৃষি উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads