• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
নদীমাতৃক বাংলাদেশ

নদী এ দেশের মানুষকে মাতৃরূপে স্নেহদান করেছে

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

নদীমাতৃক বাংলাদেশ

  • কামরুল আহসান
  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

নদীমাতৃক দেশ-বাংলাদেশ। গঙ্গার অববাহিকায় পলি জমে জমে সৃষ্টি হয়েছিল একদিন এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ গঙ্গাঋদ্ধি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ, বংশী, ডাকাতিয়া, কীর্তনখোলা, কর্ণফুলী, কুমার, কুশিয়ারা, সুরমা, তিস্তা, ঘাঘট, কংস, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, যমুনেশ্বরী, চিত্রা, গড়াই, দুধকুমার, মহানন্দা, করতোয়া কতসব অপরূপ নাম এসব নদীর। এই নদীগুলোর তীর ঘিরেই গড়ে উঠেছে এদেশের জনপদ, শহর-বন্দর-গ্রাম। বলা হয় মানুষের এই সভ্যতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নদীরই। নদীর তীর ধরেই উঠেছে হাজার বছরের পুরনো মানবসভ্যতা। আর এই বাংলার মানুষের কাছে নদীর অবদানের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। এই মৎস-কৃষি-যোগাযোগ ব্যবস্থা সবই নদীকে ঘিরে। শুধু বৈষয়িক প্রয়োজন নয়, নদী এ অঞ্চলের মানুষের আত্মিক বন্ধুও। তার সব সুখ-দুঃখের সঙ্গী। তার আধ্যাত্মিক সাধনার স্থান। নদী এখানে জীবন নদীর প্রতীক। এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও বিকশিত হয়েছে নদীর হাত ধরে। তাই নদী এ দেশের মানুষের কাছে মাতৃরূপে আবির্ভূত হয়েছে। মা যেমন সন্তানকে দুগ্ধদান করে বাঁচিয়ে রাখে, নদীও তেমন এ দেশের মানুষকে মাতৃরূপে স্নেহদান করেছে। তাই বাংলার প্রধান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবাসে বিজনে বসে তার ছেলেবেলার ফেলে যাওয়া নদী যশোরের কপোতাক্ষ নদ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে/দুগ্ধস্রোতরূপী তুমি মাতৃভূমি স্তনে।’ বাংলার আরেক প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশও আবার তার ধানসিড়ি নদীটির পাশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। শুধু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদেরই এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনব্যাপী নদী আবর্তিত। হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ শুধু নদীকে নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করেছে। আজ নদীর সঙ্গে তার বন্ধন অনেকখানি ছুটে গেছে। নদীকে শাসন-শোষণ করে মানুষ নদীগুলো ধ্বংসের আয়োজন করছে। কিন্তু নদী শুধু সম্পদ আহরণের উপায়মাত্র নয়, নদী জীবনেরই রূপ। নদীরও আছে আলাদা এক জীবন। প্রকৃতির ভারসাম্য, প্রাণচক্র নদীই সবচেয়ে ভালো উপায়ে সংরক্ষণ করে।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগের নাম জলবায়ুর পরিবর্তন। গলে যাচ্ছে লাখো বছরের জমাটবদ্ধ হিমবাহ। ফলে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। তার প্রভাবে সৃষ্টি হচ্ছে অকাল বৃষ্টি, বন্যা। প্রকৃতির এ ভারসাম্যহীনতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে নদীর ওপর। আর নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এত নিবিড় যে, নদী যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে মানুষেরও ধ্বংস অনিবার্য। বিশ্বজুড়েই এখন নদী বাঁচাও আন্দোলন নিয়ে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। এটা আমাদের মতো দেশের জন্য আরো সবচেয়ে বেশি দরকার। বাংলাদেশেও এখন পরিবেশ বাঁচাও, নদী বাঁচাও আন্দোলনে অনেকে সচেতন হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। আমাদের নদীগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। বালু উত্তোলন, নদী দখল, নদীর তীরে গড়ে তোলা অপরিকল্পিত কলকারখানা ইত্যাদিই তার কারণ। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট-বড় নদী। ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারাজ, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোও এখন বিপর্যয়ের মুখে। বর্ষাকাল ছাড়া সেগুলোতে তেমন পানি থাকে না। ফলে তার প্রভাব পড়ে অন্য ছোট  নদীগুলোতেও। এতে নদীর স্বাভাবিক চলায় যেমন বিঘ্ন ঘটছে, বিঘ্ন ঘটছে তার প্রাণচক্রেও। আরো অসংখ্য নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহিত হতে পারছে না। যার পরিণতি হচ্ছে বন্যা। বন্যা বাংলাদেশের আরেক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। নদী ভাঙনের ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর লাখ লাখ হেক্টর কৃষিজমি। অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু, গৃহহীন, বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ছে। একটা কথাই শুধু মনে রাখতে হবে আমাদের, নদী না বাঁচলে আমরা বাঁচব না। সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের দরকার নদীর প্রতি ভালোবাসা। 

তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা

বাংলাদেশের প্রধান তিন নদী পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। এই তিন নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে বাংলার বিশাল জনপদ। অসংখ্য শহর-বন্দর-গ্রাম। এই তিন নদী থেকেই বেরিয়েছে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা-উপনদী। বাংলার  মানুষের অনাদিকালের সাক্ষী এই তিনটি নদী। ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান স্লোগান ছিল তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা...

পদ্মা বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। যার দৈর্ঘ্য ৩৬০ কিলোমিটার। এটি গঙ্গার প্রধান শাখা, বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। চাঁদপুরে গিয়ে এটি মেঘনা ও যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। পদ্মা বাংলাদেশের মানুষের অসংখ্য অজস্র সুখ-দুঃখের সাক্ষী। পদ্মার তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শহর-বন্দর-গ্রাম। একে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান-কবিতা।

মেঘনা বাংলাদেশের গভীর ও প্রশস্ততম নদী এবং অন্যতম বৃহৎ ও প্রধান নদী। এর জন্ম আসামের লুসাই পাহাড়ে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলায় গিয়ে এটি পদ্মা-যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৫৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৪০০ মিটার। নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। মেঘনার অসংখ্য বাঁকে গড়ে উঠছে বাংলাদেশের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দর-নগর। 

যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর একটি। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান শাখা। যমুনা গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এর পূর্ব নাম জোনাই। ১৭৮৭ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নতুন খাতে প্রবাহিত হয়ে এই নদীর সৃষ্টি করেছে। উৎপত্তিস্থল হতে এর দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার। উত্তর ভারতেও যমুনা নামে একটি নদী আছে, যার তীরে গড়ে উঠেছে তাজমহল, তবে এই যমুনা আর সেই যমুনা এক নয়। যমুনা এক অপরূপ নদী, যার জলের রঙ অনেকটা নীল, স্বচ্ছ কাচের মতো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads