• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বিশ্ব নদী দিবসের প্রবর্তক মার্ক অ্যাঞ্জেলো ও বাংলাদেশ

বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যাঞ্জেলো

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

বিশ্ব নদী দিবসের প্রবর্তক মার্ক অ্যাঞ্জেলো ও বাংলাদেশ

  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শেখ রোকন

নদীবিষয়ক বৈশ্বিক আন্দোলন বা প্রচারণার খবর যারা রাখেন, তাদের কাছে মার্ক অ্যাঞ্জেলোকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিষ্ঠাতা। দিবসটির সূচনা হয়েছিল কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে। আশির দশকের গোড়ায়, আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তরুণ শিক্ষক এবং নদীপ্রেমিক মার্ক অ্যাঞ্জেলো তার কিছু ছাত্রছাত্রী ও বন্ধুকে নিয়ে ফ্রেজার নদীতে ‘ক্লিন আপ’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নদীটি র্যাফটিংয়ের জন্য জনপ্রিয় ছিল; কিন্তু যারা অংশ নিতেন তারা বেশিরভাগই খাবারের প্যাকেট, র্যাফটিংয়ের যন্ত্রাংশ, বিনোদন উপকরণ প্রভৃতি নদী বা তীরে ফেলে যেত। মার্ক অ্যাঞ্জেলো ও তার ছাত্রছাত্রী, বন্ধু-সহকর্মীরা সেগুলো পরিষ্কার করেন। তিনি পরবর্তীতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ওই দিনের কর্মসূচির পর সবাই উজ্জীবিত ছিল এবং পরের বছরও একই দিনে একই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল।

পরের বছরগুলোতে সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার নদী পরিষ্কার করার কর্মসূচি ক্রমেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রথমে দিনটিকে ফ্রেজার রিভার ডে, তারপর ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রিভার ডে, তারপর কানাডা রিভার ডে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ততদিনে দিবসটির উদযাপন কানাডার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এর নাম হয় ‘বিশ্ব নদী দিবস’। এই দিবস নর্থ আমেরিকা, সাউথ আমেরিকা, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ২০০৫ সালে এসে জাতিসংঘ দিবসটি সমর্থন করে এবং ২০১৫ সাল পর্যন্ত ‘ওয়াটার ফর লাইফ ডিকেড’ কর্মসূচির অংশ করে নেয়। মার্ক অ্যাঞ্জেলো ততদিনে তার নদীপ্রেমের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনিই প্রতিষ্ঠিত হন দিবসটির জাতিসংঘ চেয়ার হিসেবে।

বাংলাদেশে দিবসটি পালনের সূচনা হয় ২০১০ সালে। আজ যখন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ দিবসটি পালন করছে, তখন পেছনে ফিরে দেখে এক ধরনের শ্লাঘা বোধ হয়। কারণ বাংলাদেশে এর সূচনা করেছিল ‘রিভারাইন পিপল’। এর পেছনেও রয়েছে কৌতূহল উদ্দীপক ইতিহাস।

২০০৯ সালের দিকের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা ‘রিভার লাভিং পিপল’ নামে যে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন করতাম, ততদিনে সেটা ‘রিভারাইন পিপল’ নাম নিয়েছে। আমরা ঠিক করেছিলাম, রিভারাইন পিপল শুধু নদী নিয়ে কাজ করবে। আর ১০টি পরিবেশ আন্দোলনের মতো সবকিছু নিয়ে নয়। আমার মাথায় চিন্তা এলো একটা ‘নদী দিবস’ কেন নয়? পরিবেশ দিবস রয়েছে, পর্বত দিবস রয়েছে, বন দিবস রয়েছে, মহাসাগর দিবস রয়েছে, এমনকি পানি দিবসও রয়েছে। ‘নদী দিবস’ থাকবে না কেন?

এই সময়ই চোখে পড়ল ‘বিশ্ব নদী দিবস’। তবে আশপাশের কোনো দেশে নয়, মূলত উন্নত বিশ্বে পালিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতার নামও জানলাম। তাকে ই-মেইল করে জানালাম, আমরা বাংলাদেশের একটি তরুণ নদীকর্মী গোষ্ঠী পরের বছর বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে চাই। তিনি প্রথমে সম্ভবত বিস্মিত হলেন, এতদূর থেকে মেইল পেয়ে। তারপর খুবই উৎসাহ দিলেন, অনুপ্রেরণামূলক কথা বললেন। বললেন, আমাদের প্রতি তার বিশেষ নজর থাকবে।

প্রশ্ন উঠল, দিবসটির ‘প্রতিপাদ্য’ কী? আবার মেইল করলাম মার্ক অ্যাঞ্জেলোকে। তিনি বললেন, এই দিবসের কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিপাদ্য নেই। দেশ ও অঞ্চলভেদে আলাদা প্রতিপাদ্য ঘোষিত হতে পারে। বাংলাদেশ প্রতিপাদ্য কে ঘোষণা করবে? তিনি বললেন, তোমরাই কর! আমি অনুমতি দিচ্ছি। আমরা ঠিক করলাম বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপাদ্য : ‘নদী ডাকছে, আমরা সাড়া দেব না?’

মার্ক অ্যাঞ্জেলো যে রিভারাইন পিপলকে মনে রেখেছিলেন, তার প্রমাণও পেয়েছিলাম ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। তিনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন। আমাকে খুঁজে বের করেছিলেন। আমরা প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিলাম। অনেক আলাপ, ভাববিনিময় হয়েছিল। একসঙ্গে বেশকিছু ছবিও তুলেছিলাম। আমাদের অনিয়মিত ইংরেজি সাময়িকী দ্য রিভ্যুলেটের কাজ চলছিল তখন। তিনি ডামি কপিতে অটোগ্রাফ দিলেন, ‘থ্যাঙ্কস ফর ইউর গ্রেট অ্যাফোর্ট’।

শুধু রিভরাইন পিপল নয়, বাংলাদেশে নদী আন্দোলন, বিশেষ করে বিশ্ব নদী দিবস পালনের মাত্রা ও সম্প্রসারণ তাকে মুগ্ধ করেছে। এবার বিশ্ব নদী দিবসের আগেও আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নদী দিবস পালনে বাংলাদেশের ভূমিকা আমার জন্য ও বিশ্ববাসীর জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। আমি আপনাকে, আপনার সহযোদ্ধাদের এবং আরো যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন নদী দিবস পালন করছে, সবাইকে অভিনন্দন জানাই। সুনির্দিষ্টভাবে রিভারাইন পিপল বিশেষ স্বীকৃতির দাবি রাখে। তারা বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপনের সূচনা করেছিল।’

আমরা জানি, বাংলাদেশের নদীগুলো ভালো নেই। কিন্তু আশার কথা, নদী নিয়ে কথাবার্তা, আলোচনা বাড়ছে। যূথবদ্ধ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ। ‘বিশ্ব নদী দিবস’ উদযাপন তেমনই একটি উদাহরণ। আর কে না জানে যে, মানুষ যখন একত্র হয়, মিছিলে যখন পায়ের সংখ্যা বাড়ে; কোনো লক্ষ্যই বেশিদিন অধরা থাকে না। বাংলাদেশের নদীগুলোও একদিন নিশ্চয়ই উদ্ধার হবে।

লেখক : মহাসচিব, রিভারাইন পিপল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads