• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
নারীর প্রতি সহিংসতারোধে প্রয়োজন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

নারীর প্রতি সহিংসতারোধে প্রয়োজন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি

  • প্রকাশিত ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

‘আঁর মাতাত যন আঘাত কইচ্ছে, তন আঁর আর হুঁশ নাই, কই গেছি, কী কইচ্ছি কিচ্ছু মনে নাই।’ কুমিল্লা সরকারি মেডিকেল কলেজের বেঞ্চে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কথাগুলো বলেছেন মানছুরা বেগম। চাটখিলে পাকা সড়কের পাশে ভোরবেলা প্রায় মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাকে। তার মাথা, কপাল, পুরো শরীর, হাত ও পায়ে মারাত্মক জখম। স্থানীয় লোকজন তাকে দেখতে পেয়ে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। তখন তার জ্ঞান ছিল না। প্রাথমিক চিকিৎসার পর সে শুধু তার বাবার টেলিফোন নম্বরটি বলতে পেরেছে। টেলিফোনে খবর পেয়ে বাবা আহসান উল্লাহ মুন্সী ও ছোটভাই আমান উল্লাহ পার্শ্ববর্তী বরুড়া উপজেলা থেকে দ্রুত চাটখিলে পৌঁছে। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আহসান উল্লাহ মুন্সী কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্থানীয় ক্লিনিকের ডাক্তার দ্রুত রোগীকে কুমিল্লা নিয়ে যেতে বলেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সঙ্গে সঙ্গে মানছুরাকে কুমিল্লার কুচাইতলীতে জেলা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উপস্থিত ডাক্তাররা রোগীর অবস্থা দেখে দ্রুত রক্ত সরবরাহ করতে বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করেন।

ইতোমধ্যে ক্যামেরাসহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক উপস্থিত হন। তাদের ধারণ করা সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হয় এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘যৌতুকের দাবিতে স্বামীর অত্যাচারে স্ত্রী মুমূর্ষু’ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশিত হয়। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তার স্বামীর অত্যাচারের বীভৎসতা বর্ণনা করেন এবং রোগী সুস্থ হতে তিন মাস সময় লাগবে বলে জানান।

বছর ছয়েক আগে মানছুরার বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী শাহরাস্তি উপজেলার যোবায়ের মিয়ার সঙ্গে। যোবায়ের ঢাকায় একটি নামিদামি হোটেলে ওয়েটার পদে চাকরি করে। দেখতে সুঠামদেহী যোবায়েরের বিদ্যা-শিক্ষা তেমন নেই। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে। মানছুরা মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেছে। গরিব বাবা আহসান উল্লাহর পক্ষে এর চেয়ে ভালো পাত্র পাওয়া সম্ভব নয়। তাই কিছুটা শ্যাম বর্ণের মানছুরার বিয়েতে আহসান উল্লাহ ও আত্মীয়-স্বজন রাজি হয়ে যান। যেদিন বিয়ে হবে, সেদিন একটি খবর পাওয়া যায়, যোবায়ের আগে আরেকটি বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ের সব আয়োজন সমাপ্ত। মেহমানরা চলে এসেছেন। এ অবস্থায় বিয়ে ফেরানো সম্ভব নয়। যোবায়েরের সঙ্গে মানছুরার বিয়ে হয়ে গেল। শর্ত হিসেবে বিয়ের সময় এক লাখ টাকা যৌতুক দেওয়া হলো।

আহসান উল্লাহ মুন্সীর আয় বলতে তেমন কিছু নেই। মাঠে জায়গাজমি নেই। সকালে একটি মক্তবে বাচ্চাদের কোরআন শেখান। এ থেকে যৎসামান্য আয়। আর একটি সেলাই মেশিনে ছেঁড়াফাটা কাপড় ও লুঙ্গি সেলাই করে যা আয় হয় তা দিয়ে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে কোনোরকম জীবন কাটে তাদের। দুই ছেলে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে কোরআন হেফজ করেছে এবং ওই মাদরাসায় কওমি লাইনে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। মেয়ের জামাইকে এক লাখ টাকা যৌতুক দিতে আহসান উল্লাহকে গ্রামের বিত্তবানদের কাছে হাত পাততে হয়েছে।

ইতোমধ্যে মানছুরা পাঁচ বছরের মীম ও দুই বছরের আলিফের মা। স্বামী যোবায়েরের যৌতুকের চাহিদা মেটে না। এর মধ্যে বাবার কাছ থেকে চেয়ে স্বামীকে আরো চল্লিশ হাজার টাকা দিয়েছে। গেল ঈদে বাড়ি এসে যোবায়ের এক লাখ টাকা লাগবে বলে জানায় তার শ্বশুরকে। বাবার কাছ থেকে আনতে না পারলে তাকে আর রাখবে না- সাফ জানিয়ে দিল যোবায়ের। ‘আমি পারব না, আপনার যা ইচ্ছা তা-ই করেন’- মানছুরা একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পাশের চেয়ার তুলে যোবায়ের তার মাথায় আঘাত করে। এতে মানছুরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

মানছুরা মারা গেছে ভেবে বিষয়টিকে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বলে বোঝানোর জন্য তার সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত করে বাড়ি থেকে অনেক দূরে পাকা সড়কের পাশে ফেলে আসে যোবায়ের। আর পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে বলে বেড়ায়- মানছুরা রাতে পালিয়ে গেছে। তারা তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।

এদিকে মেয়েকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তার শরীরের মারাত্মক জখম সারাতে যে ওষুধ প্রয়োজন, তা হাসপাতালে না থাকায় বাইরে থেকে কিনে দিতে হচ্ছে। প্রতিদিন মানছুরাকে তিন হাজার টাকার ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। অসহায়, গরিব আহসান উল্লাহ চোখে অন্ধকার দেখছেন। শেষসম্বল বিক্রি করে এবং পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের দানে কোনোরকমে চিকিৎসা চলছে। যৌতুকের দাবিতে স্বামীর নির্মম অত্যাচারের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছেন মানছুরার বাবা-মা। বিষয়টি নিয়ে উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উকিল জানান, একদিনের মধ্যে অত্যাচারী স্বামী যোবায়েরের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে দেবেন। এতে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। এর কমে কিছুতেই হবে না। স্বল্পশিক্ষিত আহসান উল্লাহ সমুচিত বিচার পাওয়ার আশায় কষ্টে-শিষ্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করে উকিল সাহেবের হাতে দিলেন। সপ্তাহের প্রথম দিন নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মামলা হলো। জজ সাহেব ছবিতে অত্যাচারের বীভৎসতা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ওয়ারেন্ট জারি করলেন। থানায়ও আদেশ গেল আসামি ধরার জন্য। একই মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে দেওয়া হলো। তদন্তের জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো।

এরই মধ্যে প্রায় এক মাস গত হলো। আসামি ধরা পড়েনি। উপরন্তু শোনা গেল আসামিপক্ষ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলার পেছনে দৌড়ানোর মতো শক্তি-সামর্থ্য আহসান উল্লাহর নেই। এখন তিনি আল্লাহর কাছে বিচার চেয়ে মেয়ের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুগোপযোগী আইন রয়েছে। এতে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রতা অনেকাংশে বাদীপক্ষকে হতাশ করে ও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার জন্য তাকে আপস করতে হয়। আইন অনুযায়ী নারী নির্যাতনের সব অপরাধই বিচারের জন্য গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ আপস-মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দেখা যায় বিচার চলাকালেও আপস হয়।

অনেকক্ষেত্রে সচরাচর ভুক্তভোগীদের চেয়ে আসামিপক্ষ সবল থাকে। তাদের চাপে আসামিপক্ষ আপস করতে বাধ্য হয়। অনেকসময় চাপটা এমন হয় যে, আপস করতে হবে, নতুবা এলাকা ছাড়তে হবে। অনেকসময় দেখা যায় স্বয়ং ভুক্তভোগী আদালতে হলফনামা বা সাক্ষ্য দিয়ে মামলা তুলে নিচ্ছেন। তবে ভুক্তভোগী যদি দেখেন মামলা সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে, সঠিক বিচার পাওয়া যাবে, তখন তিনি আপসের দিকে যান না। আর আসামিপক্ষ যদি দেখেন, টাকার জোরে আসামি খালাস পেয়ে যাবে, তখন আপস করে ফেলেন। পিবিআই’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগায় ৩৭ শতাংশ বাদী আপস করেছেন। বিচার দেরি হলে বাদীপক্ষের লোকজনও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে আসেন না।

১৯৮৬ সালে নির্যাতিত নারীদের আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের কার্যক্রম শুরু হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে এ সেলের কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এ কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করার জন্য মহিলা সহায়তা কর্মসূচি প্রকল্প নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।

এ প্রকল্পের আওতায় ৬টি বিভাগীয় শহরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে ৬টি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল ও মহিলা সহায়তা কেন্দ্রের কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে- অসহায় নির্যাতিত মহিলাদের বিনাখরচে আইনগত পরামর্শ প্রদান, নির্যাতিতা ও অসহায় নারীদের অভিযোগ গ্রহণ এবং বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দান, বাদী ও বিবাদীপক্ষের মধ্যে সালিশ/কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে পারিবারিক কলহ মীমাংসা করা, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীদের ভরণপোষণ আদায়ের ব্যবস্থা করা; নির্যাতিত ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের দেনমোহর আদায়ের ব্যবস্থা করা, নাবালক সন্তানের খোরপোশ আদায়ের ব্যবস্থা করা, যৌতুক প্রথা নিরুৎসাহিত করা, বাল্যবিয়ে নিরোধের পক্ষে কাজ করা ইত্যাদি। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে যে কোনো নম্বর থেকে হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যায়। সরকারের এসব কর্মসূচি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আইনে তদন্ত বিচারের জন্য সময়সীমাসহ পুলিশ, ডাক্তার, পিপি ও ট্রাইব্যুনালের জবাবদিহির বিধান আছে। বিষয়টি আরো নজরদারির মধ্যে থাকা উচিত। তাহলে ভুক্তভোগীর সঠিক বিচার নিশ্চিত হবে।

 

এ এম মোতাহের হোসেন

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads